কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বলতে আমরা বুঝি, যেখানে কৃষি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়| অর্থাৎ কিছু নির্দিষ্ট বিশেষিকৃত শস্য উৎপাদন করা হয় গ্রামের ভোগের জন্য নয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির জন্য| ভারতবর্ষে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনকালে| অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে কৃষি সম্পত্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল|
প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল 1813 খ্রিস্টাব্দে পর যখন ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব গতি পেতে শুরু করেছিল| 1860 খ্রিস্টাব্দে নাগাদ ভারতবর্ষে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠে|
প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল 1813 খ্রিস্টাব্দে পর যখন ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব গতি পেতে শুরু করেছিল| 1860 খ্রিস্টাব্দে নাগাদ ভারতবর্ষে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠে|
ভারতবর্ষে প্রাথমিকভাবে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ শিল্প সংঘকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল জোগান দেওয়ার জন্য| অর্থাৎ ব্রিটিশ শিল্প কলকারখানায় যে সকল কাঁচামাল প্রয়োজন পড়তো, সেগুলি অথবা যেসকল কাঁচামাল বিক্রি করে ইউরোপে অথবা আমেরিকার থেকে নগদ অর্থ লাভ করত, সেগুলি উৎপাদন করা হতো| কারণ হিসাবে আমরা তুলা উৎপাদনের কথা বলতে পারি| এছাড়া নীল চা এবং কফি চাষের কথা উল্লেখ করা যায়, এই প্রসঙ্গে বলা যায় বেশিরভাগ বাণিজ্যিক শস্যের চাষ নিয়ন্ত্রণ করত ইংরেজরা|
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সংগঠনের উপায়
ভারতবর্ষের কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নীতি এবং কার্যকলাপের ফলে| ব্রিটিশ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন ভূমি ব্যবস্থা জমিকে স্বাধীনভাবে অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর মতো বিক্রয়ের উপকরণে পরিণত করত| চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের জমির মালিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং ধনী সম্পদশালী ভূস্বামী শ্রেণির সৃষ্টি করা হয়| যাদের কৃষিজ পণ্য জীবনধারণের জন্য অথবা ভোগ পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেগুলি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়েছিল|
যাইহোক তুলা, পাট, আখ, সুপারি, তামাক প্রভৃতি পণ্যের বাজারে চাহিদা ছিল যথেষ্ট| এর ফলে এই সকল পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল| বাগিচা শস্য হিসেবে চা, কফি, রাবার, নীল প্রভৃতি চাষের সূত্রপাত ভারতবর্ষের কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূত্রপাত করে| এই সকল পণ্য বাজারে চাহিদা ছিল খুব এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এক নতুন উচ্চতা বিরাজ করেছিল|
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ ছিল বেশিরভাগ ভারতীয় কৃষকের কাছে বাধ্যতামূলক এবং কৃত্রিম পদ্ধতি| কৃষকদেরকে বাণিজ্যিক শস্য চাষ করতে বাধ্য করা হত| কৃষককে জমি ভোগের জন্য বৃটিশ সরকারকে ঠিক সময় রাজস্ব প্রদান করতে হতো| অধিকিন্তু কৃষক তার নির্দিষ্ট জমিতে ইংরেজ বাগিচাকারীদের অত্যাচারী চাষ করতে বাধ্য হতো| এইভাবে ভারতবর্ষে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সূত্রপাত ঘটে|
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের কারণ
ভারতের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণের পেছনে একাধিক কারণ ছিল| ব্রিটিশ সরকার সমগ্র ভারত জুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল| এর ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে একটি সুসংগঠিত ভারতীয় বাজার গড়ে উঠেছিল| এছাড়া টাকা-পয়সা কেন্দ্রিক অর্থনীতির বিনিময় ভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে বাজারি অর্থনীতির সূত্রপাত ঘটেছিল|
- সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক ভারত, ব্রিটেন কাঁচামাল এবং খাদ্য সামগ্রীর হ্রাস করে| ব্রিটিশ কারখানা জাতীয় দ্রব্য আমদানিকারীতে পরিণত হয়েছিল| বিভিন্ন বাণিজ্যিক শস্য যথা- তুলা, পাট, আখ, সুপারি, তামাক উৎপাদন বিশেষভাবে শুরু হয়েছিল ব্রিটেনের চাহিদা পূরণের জন্য|
- প্রথা এবং চিরাচরিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা এবং চুক্তি ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণ ঘটতে সাহায্য করেছিল| যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি বিশেষ করে রেল যোগাযোগ এবং জাহাজ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে কৃষিজাত দ্রব্যের দূরবর্তী স্থানগুলিতে বাণিজ্যের জন্য নিয়ে যাওয়া সহজ সাধ্য হয়েছিল| এই প্রসঙ্গে শস্য ব্যবসায়ীদের উদ্ভব কৃষিজাত দ্রব্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল|
- অর্থের মাধ্যমে অথবা টাকার বিনিময় রাজস্ব দেওয়ার নীতি গৃহীত হওয়ায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সহজসাধ্য হয়েছিল| কারণ নগদ অর্থের প্রয়োজনে কৃষক সেই সকল দ্রব্য উৎপাদন করত যেগুলি বিক্রি করে নগদ অর্থ পাওয়া যেত|
- ভারতবর্ষে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্রমাগত গতি লাভ| এর ফলে ব্রিটিশ শিল্প কারখানাগুলিতে যে সকল কাঁচামালের প্রয়োজন পরত, সেগুলি যোগান দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করা শুরু হয়েছিল|
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং প্রসার ও ব্রিটিশ পুঁজি বিনিয়োগ কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য দায় ছিল| কারণ বৃটিশ ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক শস্য চাষের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করত| এছাড়া কিছু বাণিজ্যিক শস্য যা বিদেশের বাজারে ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধি, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের কারণ বলা যেতে পারে|
- আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ ভারতে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল| এরফলে ইংল্যান্ডের তুলোর চাহিদার দিক ভারতের অভিমুখী হয়েছিল| এই চাহিদা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরেও বজায় ছিল, কারণ ভারতবর্ষে সুতি বস্ত্র শিল্পের সূচনা ঘটেছিল|
- ব্রিটিশ সরকারের অবাধ বাণিজ্যনীতি ভারতবর্ষের কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের সহায়ক হয়েছিল| উদাহরণ হিসেবে পাট এবং সুতি শিল্প পণ্যের কথা উল্লেখ করা যায়| কারণ পাট এবং তুলোজাত় দ্রব্য ভারতের বাজারে অবাধে প্রবেশ করতে থাকে, কিন্তু ইউরোপীয় বাজারে এই সুবিধা ছিল না|
উপসংহার
সর্বশেষে বলা যায়, ভারতের কৃষকরা বাণিজ্যিক শস্য চাষের জন্য ঋণ দাতাদের কাছ থেকে ঋণ পেত এবং সুদসহ যথাসময়ে তা ফেরত দিতে পারত| ফলে বাণিজ্যিক শস্য চাষের উৎসাহ ছিল|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Sonali Bansal, "Modern Indian History".
সম্পর্কিত বিষয়
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................