বর্তমান পেনার ও ভেলার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাঞ্জর, ত্রিচিনাপল্লী ও পদুকোটাই অঞ্চল নিয়ে গঠিত চোল রাজ্য বা chola State ছিল এক অতি প্রাচীন জনপদ| মহাভারত, তামিল, সঙ্গম সাহিত্য, মহাবংশ, অশোকের বিভিন্ন শিলালিপিতে চোলদের বিভিন্ন উল্লেখ পাওয়া যায়|
অশোকের রাজত্বকালে তার শ্যামলা রাজ্যের বাইরে সুদূড় দাক্ষিণাত্যে যে চারটি স্বাধীন রাজ্য ছিল তার মধ্যে চোল রাজ্য ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী| কারিকল প্রতিষ্ঠিত চোল রাজ্য প্রথম রাজেরাজ এবং প্রথম রাজেন্দ্র চোলের আমলে এর সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেছিল| 1310 খিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি মালিক কাফুরের আক্রমণের ফলে চোল শক্তির পতন ঘটে|
অশোকের রাজত্বকালে তার শ্যামলা রাজ্যের বাইরে সুদূড় দাক্ষিণাত্যে যে চারটি স্বাধীন রাজ্য ছিল তার মধ্যে চোল রাজ্য ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী| কারিকল প্রতিষ্ঠিত চোল রাজ্য প্রথম রাজেরাজ এবং প্রথম রাজেন্দ্র চোলের আমলে এর সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেছিল| 1310 খিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি মালিক কাফুরের আক্রমণের ফলে চোল শক্তির পতন ঘটে|
দারুসুরম মন্দির - এটি চোলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল |
প্রাচীন ভারতে এক সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চোলদের প্রশাসনিক দক্ষতার কথা প্রমাণিত হয়|চোলরাজ প্রথম পরত্মক এর শিলালিপি, রাজরাজের তাম্রলিপি, সমসাময়িক মুদ্রা এবং বিভিন্ন বিদেশি পর্যটক এর বিবরণ থেকে চোল শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়|
দাক্ষিণাত্য তথা সমগ্র দক্ষিণ ভারতে চোলরা প্রথম এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যদিও এই শাসন ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব ছিল যথেষ্ট| রাজা কেন্দ্রীয় শাসনের শীর্ষে অবস্থান করলেও প্রাদেশিক শাসনের প্রতি তাকে সমান গুরুত্ব প্রদান করতে হতো| চোল শাসন ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, 'স্থানীয় স্বায়ত্ত প্রতিষ্ঠা', এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রজার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়|
চোল শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করতেন রাজা| চোল শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক এবং মূলত জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনে অধিকারী হতো| চোল 'চক্রবর্তী', 'গঙ্গায়কান্ত' প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করতেন| তারা সর্ব শক্তির আধার হয়েও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না| একটি সংঘবদ্ধ আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা হতো| তার মৌখিক বাক্যগুলো আইন হিসেবে পরিগণিত হতো| রাজাকে শাসনকার্যে পরামর্শ দেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ ছিল| রাজ কর্মচারীরা তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে জমির মালিকানা নয়, শুধুমাত্র জমি থেকে রাজস্ব আদায়ে দায়িত্ব পেতেন|
সমগ্র চোল রাজ্যকে বলা হতো 'চৌলমন্ডলম'| চোল রাজ্য মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল-
- রাজার প্রতক্ষ্য শাসনাধীন অঞ্চল
- সামন্ত শাসিত অঞ্চল
'কোট্টায়ম' বা জেলায় বিভক্ত ছিল| নাডু গঠিত হতো কতগুলি 'কুররম' বা গ্রামের সমষ্টি নিয়ে গঠিত হতো, মূলত রাজার প্রতক্ষ্য শাসনাধীন অঞ্চলে মন্ডলগুলিতে রাজপুত্ররা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন| চোল রাজ্যের সামন্তরাজারা বেশ কিছু অঞ্চল শাসন করতেন| এই শাসন করার অধিকারের বিনিময় তারা রাজাকে কর প্রদান করতেন, এছাড়াও যুদ্ধকালীন অবস্থায় রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে হত|
বিভিন্ন লিপি থেকে জানা যায় যে, ভূমি রাজস্ব ছিল সরকারি আয়ের প্রধান উৎস| মোট কৃষিজ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ব হিসেবে প্রদান করতে হত| বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন- যুদ্ধ, বাঁধ সংস্কার ও মন্দির নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হতো| তবে দুর্ভিক্ষকালীন সময় আংশিক বা পুরো কর মুকুব করা হতো|
চোলরাজ্যে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার হত মূলত গ্রামীণ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে| রাজকীয় বিচারালয় পরিচালিত ছিল ধর্মাসন নামে| দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার একসাথে হতো| চোল সেনাবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তি বাহিনী ও নৌবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ছিল| চোল নৌবাহিনী ছিল তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠ নৌবাহিনী|
পদাতিক সৈন্য |
অশ্বারোহী সৈন্য |
চোল শাসনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা| এই সময়ে গ্রামগুলি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং গ্রামবাসীদের হাতে গ্রাম শাসনের ক্ষমতা ছিল| প্রত্যেক গ্রামে নির্বাচিত সাধারন সভা থাকতো| এই সাধারণ সভা আবার "উর" এবং "মহাসভা" এই দুটি অংশে বিভক্ত ছিল| গ্রামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উর এর সদস্য ছিল এবং ব্রাহ্মণ শাসিত গ্রামগুলিতে মহাসভার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হতো| উর এবং মহাসভার হাতে গ্রামীণ উন্নয়ন এবং রাজস্ব আদায়, বিচার, শিক্ষা, শিল্প পরিচালনার দায়িত্বভার থাকতো|
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে চোল শাসন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল| রাজনৈতিক প্রাধ্যানের পাশাপাশি উন্নত শাসনব্যবস্থা, স্বায়ত্ত শাসন, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চোল যুগ এক নিজস্বতা ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছিল| এই সকল কারণে, খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রায় 200 বছর ধরে চলা চোল যুগ দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে "সুবর্ণ যুগ" হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে|
তথ্যসূত্র
- সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস" (প্রথম খন্ড)
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India"
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century"
সম্পর্কিত বিষয়
- মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা (আরো পড়ুন)
- বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................