পাহাড়পুর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলার চাঁচল 1 নম্বর ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম| পাহাড়পুর গ্রামটি সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানকার চণ্ডীমণ্ডপটি|সাধারনত লোকমুখে এই চণ্ডীমণ্ডপ "চাঁচল পাহাড়পুরে চণ্ডীমণ্ডপ" নামে পরিচিত|
প্রায় তিনশো বছর ধরে প্রতি বছর একই নিয়ম-নীতি ধরে এই চণ্ডীমণ্ডপে মা চণ্ডীর পূজা করা হয়, সুতরাং এর একটি নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে|
আগে দেবী চণ্ডীকে সপ্তমীর দিন চাঁচল ঠাকুরবাড়ি থেকে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হতো| এই শোভাযাত্রায় ঢাক-ঢোল, সানাই বাজত এবং সামনে দিকে থাকত রাজকীয় হাতি| এই শোভাযাত্রার সময় দেবীর উপরে থাকতো রূপো-চাদির তৈরির ছত্রছায়া এবং দুপাশে থাকত চাদির তৈরি দুটি বেশ বড় পাখা|
সপ্তমীর দিন দেবী চণ্ডীকে পাহাড়পুরে চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে আসার পর তাকে স্থাপন করা হতো সনাতনী মৃন্ময়ী মূর্তির পাশে| এরপর দশমীর দিন দেবী চণ্ডীকে একইভাবে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপ থেকে আবার চাঁচল ঠাকুর বাড়িতে নিয়ে আসা হত| এই পূজায় সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো যে, এখানে দেবীর চারটি হাত রয়েছে এবং রাজবাড়ীর এই দেবীদুর্গা পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে দেবীচণ্ডী রূপে পূজিত হয়|
প্রায় তিনশো বছর ধরে প্রতি বছর একই নিয়ম-নীতি ধরে এই চণ্ডীমণ্ডপে মা চণ্ডীর পূজা করা হয়, সুতরাং এর একটি নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে|
পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপ |
পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপ স্থাপনের কথা
চণ্ডীমণ্ডপটি আগে রাজ পরিবারের একটি মন্দির ছিল কিন্তু বর্তমান সময় লোকমুখে এটি চণ্ডীমণ্ডপ নামে খ্যাত| জনশ্রুতি রয়েছে, রাজা ঈশ্বরচন্দ্র রায় চৌধুরীর পিতা রামচন্দ্র রায় চৌধুরী পাহাড়পুর সতীঘাটে চণ্ডীমূর্তি অথবা চণ্ডীঠাকুরের পেয়েছিলেন, তারপর স্বপ্নে পাওয়া দেবীর আদেশ অনুযায়ী পাহাড়পুরে ঘরের ছাউনি দেওয়া ঘরে দেবীর পূজা শুরু হলো|
আগে দেবীর পূজার জন্য বাঁকুড়া, বেনারস, কাশী প্রভৃতি জায়গা থেকে পণ্ডিতরা আসত এবং 15 দিন ব্যাপী দেবীর পূজা হত| তারপর অনেকদিন পর 1936 খ্রিস্টাব্দে চাঁচল রাজ এস্টেটের তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ এবং উৎসাহের ফলে ছাউনি দেওয়া ঘর থেকে পাকা চণ্ডীমণ্ডপে পরিণত হয়|
লোকমুখে শোনা যায় যে, চণ্ডীমণ্ডপে একসময় মহিষ এবং প্রচুর পাঠা বলি হত এবং এত বলি হত যে, লাল রক্তের বন্যা বয়ে যেত| ড্রেন বা সরু নালা পথ দিয়ে এই রক্ত প্রবাহ পাশের পুকুরে গিয়ে পড়তো এবং পুকুরের জল লাল হয়ে যেত|
আগে দেবীর পূজার জন্য বাঁকুড়া, বেনারস, কাশী প্রভৃতি জায়গা থেকে পণ্ডিতরা আসত এবং 15 দিন ব্যাপী দেবীর পূজা হত| তারপর অনেকদিন পর 1936 খ্রিস্টাব্দে চাঁচল রাজ এস্টেটের তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ এবং উৎসাহের ফলে ছাউনি দেওয়া ঘর থেকে পাকা চণ্ডীমণ্ডপে পরিণত হয়|
লোকমুখে শোনা যায় যে, চণ্ডীমণ্ডপে একসময় মহিষ এবং প্রচুর পাঠা বলি হত এবং এত বলি হত যে, লাল রক্তের বন্যা বয়ে যেত| ড্রেন বা সরু নালা পথ দিয়ে এই রক্ত প্রবাহ পাশের পুকুরে গিয়ে পড়তো এবং পুকুরের জল লাল হয়ে যেত|
রাজার আমলে চণ্ডীপূজা
মা চণ্ডীর প্রতিমা |
আগে দেবী চণ্ডীকে সপ্তমীর দিন চাঁচল ঠাকুরবাড়ি থেকে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হতো| এই শোভাযাত্রায় ঢাক-ঢোল, সানাই বাজত এবং সামনে দিকে থাকত রাজকীয় হাতি| এই শোভাযাত্রার সময় দেবীর উপরে থাকতো রূপো-চাদির তৈরির ছত্রছায়া এবং দুপাশে থাকত চাদির তৈরি দুটি বেশ বড় পাখা|
সপ্তমীর দিন দেবী চণ্ডীকে পাহাড়পুরে চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে আসার পর তাকে স্থাপন করা হতো সনাতনী মৃন্ময়ী মূর্তির পাশে| এরপর দশমীর দিন দেবী চণ্ডীকে একইভাবে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপ থেকে আবার চাঁচল ঠাকুর বাড়িতে নিয়ে আসা হত| এই পূজায় সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো যে, এখানে দেবীর চারটি হাত রয়েছে এবং রাজবাড়ীর এই দেবীদুর্গা পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে দেবীচণ্ডী রূপে পূজিত হয়|
বর্তমান সময় দেবীচণ্ডী পূজার কথা
বর্তমান সময়ে রাজাও নেই এবং রাজপরিবারও নেই, শুধু রয়ে গেছে রাজার আমলে প্রবর্তিত নিয়ম-নীতি| প্রতিবছর চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ম-নিষ্ঠা সহকারে মহালয় থেকে দশমী পর্যন্ত চন্ডীপাঠ করা হয়|
এই মণ্ডপকে ঘিরে স্থানীয়দের যথেষ্ট উৎসাহ এবং সহযোগিতা থাকে| 2013 সাল থেকে "পাহাড়পুর ভান্ডারা কমিটির" তরফ থেকে প্রতিবছর অষ্টমীর দিন সকল ভক্তগনের জন্য ভান্ডারার(প্রসাদ বিতরণ) ব্যবস্থা করা হয়|
এই মণ্ডপকে ঘিরে স্থানীয়দের যথেষ্ট উৎসাহ এবং সহযোগিতা থাকে| 2013 সাল থেকে "পাহাড়পুর ভান্ডারা কমিটির" তরফ থেকে প্রতিবছর অষ্টমীর দিন সকল ভক্তগনের জন্য ভান্ডারার(প্রসাদ বিতরণ) ব্যবস্থা করা হয়|
বিজয়া দশমী
মৃন্ময়ী প্রতিমা বিসর্জন |
দশমীর দিন মৃন্ময়ী চণ্ডী প্রতিমাকে গোধূলিবেলায় মণ্ডপের সামনে প্রায় 200 মিটার দূরে মরা মহানন্দা নদীতে বিসর্জন করা হয়| প্রায় তিনশো বছর ধরে বিদ্যানন্দপুর এর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেবী বিসর্জনের সময় লন্ঠনের আলো দেখিয়ে বিদায় দেয় এবং আজও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি|
মরা মহানন্দা নদীর ওপারে রয়েছে বিদ্যানন্দপুর নামক একটি গ্রাম এবং এই গ্রামে মূলত সংখ্যালঘু লোকেদের বসবাস রয়েছে| জনশ্রুতি আছে যে, প্রায় তিনশো বছর আগে এই গ্রামে মহামারী দেখা দিয়েছিল| এই মহামারী চলাকালীন নবমীর রাতে গ্রামের কোন এক মুসলিম ব্যক্তি মা চণ্ডী দেবীর স্বপ্ন পান এবং স্বপ্নে মা চণ্ডী তাকে নির্দেশ করেন যে, দশমী তিথির গোধূলিলগ্নে এই গ্রামের সকল মানুষজন যেন তাকে লন্ঠনের আলো দেখায়|
সুতরাং দেবী চণ্ডীর আদেশ অনুযায়ী সেইবার বিদ্যানন্দপুর গ্রামের সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা দশমীর দিন গোধূলিলগ্নে দেবীর বিসর্জনের সময় আলো দেখায়| তারপর এই গ্রাম থেকে মহামারী দূর হয়ে যায়| সেই থেকে আজও বিদ্যানন্দপুরের সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা দশমীর দিন দেবীর বিসর্জনের সময় মরা মহানন্দা নদীর ওপারে জড়ো হয় এবং লন্ডনের আলো দেখিয়ে দেবীকে বিদায় জানাই| সম্ভবত এই রকমের বিরল ঘটনা খুব কমই দেখা যায়|
এই গ্রামে সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেদের একই বক্তব্য হলযে, "মা চণ্ডী হিন্দুদের দেবতা হলেও তারাও তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে| দেবী তাদেরকে সর্বক্ষণ সুস্থ রাখেন এবং বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন| তাই দেবীর বিসর্জনের সময় এই গ্রামের সকল বাসিন্দা দেবীকে আলো দেখায়| এই রীতি কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছে| এখন এই গ্রামের সকল বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেলেও পুজো এলে তারা লন্ঠন পরিষ্কার করে রাখে এবং বিসর্জনের সময় দেবীকে সেই লণ্ঠনের আলো দেখায়"|
মরা মহানন্দা নদীর ওপারে রয়েছে বিদ্যানন্দপুর নামক একটি গ্রাম এবং এই গ্রামে মূলত সংখ্যালঘু লোকেদের বসবাস রয়েছে| জনশ্রুতি আছে যে, প্রায় তিনশো বছর আগে এই গ্রামে মহামারী দেখা দিয়েছিল| এই মহামারী চলাকালীন নবমীর রাতে গ্রামের কোন এক মুসলিম ব্যক্তি মা চণ্ডী দেবীর স্বপ্ন পান এবং স্বপ্নে মা চণ্ডী তাকে নির্দেশ করেন যে, দশমী তিথির গোধূলিলগ্নে এই গ্রামের সকল মানুষজন যেন তাকে লন্ঠনের আলো দেখায়|
সুতরাং দেবী চণ্ডীর আদেশ অনুযায়ী সেইবার বিদ্যানন্দপুর গ্রামের সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা দশমীর দিন গোধূলিলগ্নে দেবীর বিসর্জনের সময় আলো দেখায়| তারপর এই গ্রাম থেকে মহামারী দূর হয়ে যায়| সেই থেকে আজও বিদ্যানন্দপুরের সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা দশমীর দিন দেবীর বিসর্জনের সময় মরা মহানন্দা নদীর ওপারে জড়ো হয় এবং লন্ডনের আলো দেখিয়ে দেবীকে বিদায় জানাই| সম্ভবত এই রকমের বিরল ঘটনা খুব কমই দেখা যায়|
এই গ্রামে সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেদের একই বক্তব্য হলযে, "মা চণ্ডী হিন্দুদের দেবতা হলেও তারাও তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে| দেবী তাদেরকে সর্বক্ষণ সুস্থ রাখেন এবং বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন| তাই দেবীর বিসর্জনের সময় এই গ্রামের সকল বাসিন্দা দেবীকে আলো দেখায়| এই রীতি কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছে| এখন এই গ্রামের সকল বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেলেও পুজো এলে তারা লন্ঠন পরিষ্কার করে রাখে এবং বিসর্জনের সময় দেবীকে সেই লণ্ঠনের আলো দেখায়"|
ছায়া চক্রবর্তী
ছায়া চক্রবর্তী
প্রতিদিন নিয়মিত এই মণ্ডপে ঠাকুর মশাই সকাল-সন্ধ্যা পূজা করে এবং প্রতি মঙ্গলবার এখানে যজ্ঞ হয়| 82 বছরের ছায়া চক্রবর্তী প্রতিদিন নিয়মিত পুজোর আয়োজন করে|
"প্রতিটি চণ্ডীমণ্ডপে একটি নিজস্ব ইতিহাস অথবা আত্মকথা রয়েছে| কারোর আত্মকথা প্রকাশ হয়, আবার কারোর আত্মকথা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায় এবং সেই আত্মকথা হইতো আমরা আর কোনদিন জানতে পারি না"|
তথ্যসূত্র
1.W.W. Hunter , "A Statistical Account of Bengal"
2.ড.সুস্মিতা সোম, "মালদহ ভাষা-শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি"
3.ড.সুস্মিতা সোম, "মালদহ রাজ্য-রাজনীতি, আর্থ-সমাজনীতি"
4.ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়, "গৌড়-বঙ্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতি"
5.মেঘনাদ দাস, "চাঁচলের ইতিহাস"
5.মেঘনাদ দাস, "চাঁচলের ইতিহাস"
6.উত্তরবঙ্গ সংবাদ, চাঁচল, 21 শে অক্টোবর 2018
.....................................................