দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রক্রিয়া শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না, ভারতের বাইরেও তা প্রানবন্ত হয়ে উঠেছিল| ভারতের অভ্যন্তরে যেমন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, তেমনি অন্যতম শীর্ষনেতা সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ভারতের বাইরে থেকে এক অভাবনীয় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল|
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার আগে থেকেই সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের আপস নীতির সমালোচনা করতে থাকেন| অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাটি "স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজীর বিরোধ শুধু মতাদর্শের জন্য নয়, ব্যক্তিত্বের জন্য| সুভাষচন্দ্রের মধ্যে গান্ধীজি দেখেছিলেন, তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ছিল এক নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ|
1939 সালের এপ্রিল মাসে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন| তিনি চাইছিলেন, বাইরে থেকে বিদেশী শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের উৎখাত করা|
1941 সালের মার্চ মাসে সুভাষচন্দ্র ভারত থেকে গোপনে অন্তর্ধান করেন| তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির পক্ষ ত্যাগ করে মিত্রপক্ষে যোগ দেয়| সুভাষচন্দ্র জার্মানি গিয়ে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে বুঝতে পারেন যে, ভারতের স্বাধীনতা জন্য হিটলার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা করবে না|
গান্ধীজী |
গান্ধীজী |
1939 সালের এপ্রিল মাসে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন| তিনি চাইছিলেন, বাইরে থেকে বিদেশী শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের উৎখাত করা|
1941 সালের মার্চ মাসে সুভাষচন্দ্র ভারত থেকে গোপনে অন্তর্ধান করেন| তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির পক্ষ ত্যাগ করে মিত্রপক্ষে যোগ দেয়| সুভাষচন্দ্র জার্মানি গিয়ে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে বুঝতে পারেন যে, ভারতের স্বাধীনতা জন্য হিটলার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা করবে না|
সুভাষ চন্দ্রের বিদেশে গমন এবং সিঙ্গাপুরে স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা
সুভাষচন্দ্র চিন্তা করেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাপানের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে| ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের উত্থান ঘটেছিল| 1941 সালে ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাদলের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিকারিক মোহন সিং সেপ্টেম্বর মাসে আই. এন. এ ( INA ) গঠন করেন| বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাকে এই কাজে সাহায্য করেন|
1943 সালে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হয়ে আই. এন. এ- এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন| সুভাষচন্দ্র ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তথা আজাদ হিন্দ ফৌজের শীর্ষ নির্দেশক হয়ে ওঠেন| মালয়, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি অঞ্চলে জাপানিদের হাতে বন্দি অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য এতে যোগ দেয়|
এতে ঝাঁসি ব্রিগেড, গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড ও সুভাষ ব্রিগেড ছিল| সুভাষচন্দ্র দায়িত্ব নেওয়ার পর সৈন্য সংখ্যা 13 হাজার থেকে 50 হাজার এসে পৌঁছায়| 1945 সালে নেতাজি সিঙ্গাপুরে স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার স্থাপন করেন|
আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ও সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব
নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাইরে থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা| আজাদ হিন্দ সরকারের মূল ধ্বনি ছিল "জয় হিন্দ, দিল্লি চলো"|
1944 সালে জাপানি বাহিনী বার্মা জয় করে সেখান থেকে ভারতের দিকে এগিয়ে আসার সময় নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের সাথে ভারত অভিযানে যোগ দেয়| প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজের অনেক রকম সামরিক প্রতিবন্ধকতা মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছিল|
আজাদ হিন্দ ফৌজের নিজস্ব বিমান এবং সৈন্যদের হাতে আধুনিক অস্ত্র ছিল না| কোহিমা এবং ইম্ফল রণাঙ্গনে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে আজাদ হিন্দ ফৌজের তীব্র লড়াই চলে| আজাদ হিন্দ ফৌজ মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল দখল করে নেই| কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয় এবং খাদ্য ও রসদ সরবরাহ ব্যাহত হতে থাকে| জাপানি সৈন্যরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়| 1944 সালে জুন মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ রণাঙ্গন থেকে সরে আসে|
1944 সালে জাপানি বাহিনী বার্মা জয় করে সেখান থেকে ভারতের দিকে এগিয়ে আসার সময় নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের সাথে ভারত অভিযানে যোগ দেয়| প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজের অনেক রকম সামরিক প্রতিবন্ধকতা মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছিল|
আজাদ হিন্দ ফৌজের নিজস্ব বিমান এবং সৈন্যদের হাতে আধুনিক অস্ত্র ছিল না| কোহিমা এবং ইম্ফল রণাঙ্গনে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে আজাদ হিন্দ ফৌজের তীব্র লড়াই চলে| আজাদ হিন্দ ফৌজ মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল দখল করে নেই| কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয় এবং খাদ্য ও রসদ সরবরাহ ব্যাহত হতে থাকে| জাপানি সৈন্যরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়| 1944 সালে জুন মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ রণাঙ্গন থেকে সরে আসে|
সুভাষচন্দ্র বসু এবং বিমান দুর্ঘটনা
সামরিক বিপর্যয় সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করেন, উপযুক্ত সময় আবার আক্রমন শুরু হবে| এদিকে 1945 সালে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারসাম্য স্বাভাবিকভাবে মিত্রশক্তির দিকে ঢলে পড়ে|
কিছুদিন পর জাপানও আত্মসমর্পণ করে| এই পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থাকা নিরাপদ মনে না করে টোকিও অভিমুখে রওনা হন| কথিত আছে টোকিও যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়, তবে এই ব্যাপারটি আজও রহস্যকৃত|
কিছুদিন পর জাপানও আত্মসমর্পণ করে| এই পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থাকা নিরাপদ মনে না করে টোকিও অভিমুখে রওনা হন| কথিত আছে টোকিও যাবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়, তবে এই ব্যাপারটি আজও রহস্যকৃত|
নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান
আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতা সামরিক কারণে অবশ্যম্ভাবী ছিল| অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, 1944 সালে ব্রহ্ম রণাঙ্গন থেকে ভারত অভিযানের উপযোগী সময় ছিল না, কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচন্ডভাবে মার্কিন-ইঙ্গ প্রতি আক্রমণ সৃষ্টি হয়েছিল|
সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ শোনা যায় যে, তিনি নাকি ফ্যাসিবাদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন| এই প্রসঙ্গে বিপান চন্দ্র বলেছেন, কেবলমাত্র কৌশল হিসেবে সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য ফ্যাসিবাদী শক্তির সহায়তা লাভের চেষ্টা করেন| বস্তুত সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন সর্বাত্মক বিপ্লবী এবং বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ|
সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ শোনা যায় যে, তিনি নাকি ফ্যাসিবাদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন| এই প্রসঙ্গে বিপান চন্দ্র বলেছেন, কেবলমাত্র কৌশল হিসেবে সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য ফ্যাসিবাদী শক্তির সহায়তা লাভের চেষ্টা করেন| বস্তুত সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন সর্বাত্মক বিপ্লবী এবং বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ|
আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম| ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান অস্বীকার করা যায় না|
ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যের বিচার শুরু করলে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার শুরু হলে প্রতিবাদে উত্তাল গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে ঘটনাটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা|
ব্রিটিশ পতাকা |
ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যের বিচার শুরু করলে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার শুরু হলে প্রতিবাদে উত্তাল গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে ঘটনাটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা|
এই উত্তাল গণ আন্দোলন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এইভাবে-
"এই বিদ্রোহ কোনদিন দেখেনি কেউ
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ"|
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে 1944 এর শেষ দিকে থেকে 1946 সালের জুলাই পর্যন্ত নজিরবিহীন ছিল, যখন ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল| আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ভারতীয় পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ব্রিটিশ আনুগত্যে ঘুণ ধরেছিল, যুব সমাজকে সাম্রাজ্যবাদ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল|
নৌবাহিনীতে প্রতিবাদে বিদ্রোহ ঘটে, ছাত্র এবং শ্রমিকরা কলকাতার রাস্তায় নেমে লড়াই করে| সুতরাং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম এক সংগ্রামশীল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল|
নৌবাহিনীতে প্রতিবাদে বিদ্রোহ ঘটে, ছাত্র এবং শ্রমিকরা কলকাতার রাস্তায় নেমে লড়াই করে| সুতরাং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম এক সংগ্রামশীল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারতের ইতিহাস"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Sonali Bansal, "Modern Indian History".
সম্পর্কিত বিষয়
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................