ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখ এবং তার মেটরনিখ প্রণালী

1815 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের ইতিহাসকে এইচ. এ. এল. ফিশার "মেটরনিখ অথবা মেটারনিক এর যুগ" বলে অভিহিত করেছেন|ডেভিড টমসনের মতে, "এই যুগ ছিল প্রতিক্রিয়া ও রক্ষণশীলতার সঙ্গে বিপ্লবী প্রগতিরমূলক আদর্শের লড়াইয়ের যুগ"|

1815 খ্রিস্টাব্দ পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এবং অস্ট্রিয়া নিয়ন্ত্রিত সীমান্তবর্তী জায়গাগুলিতে জাতীয়তাবাদী ও উদারনীতিবাদের শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল| এই নতুন শক্তির ঢেউ জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ডকেও স্পর্শ করেছিল|
ক্লেমেন্স_ভন_মেটরনিখ_এবং_তার_মেটরনিখ_প্রণালী
ইতালির ফ্লোরেন্স শহর


কিন্তু অস্ট্রিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল প্রধানমন্ত্রী (চ্যান্সেলর) ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখ মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে, "উদারনীতিবাদ, জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য বিপ্লবী নীতিগুলি ইউরোপে বিধ্বংসী যুদ্ধের জন্য দায়ী, যে বিধ্বংসী যুদ্ধ 1792 থেকে 1815 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল"|

মেটরনিখ মনে করতেন যে, হ্যাপসবার্গ শাসনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যদি শিথিল হয়ে পড়ে তার চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি জাতি অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া নিয়ন্ত্রিত দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সমস্ত ব্যবস্থাটি ধূলায় মিশে যাবে|  বিপ্লবী শক্তি ভবিষ্যতে হ্যাপসবার্গ নিয়ন্ত্রণ ক্ষুন্ন করতে পারে, এই আশঙ্কায় মেটরনিখকে সন্ত্রস্ত করেছিল|


মেটারনিক পদ্ধতি  বা  মেটরনিখ  প্রণালী 

হ্যাপসবার্গ প্রাধান্যকে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে মেটরনিখকে তার বিখ্যাত "পদ্ধতি বা প্রণালী" উদ্ভাবন করেছিলেন| উদারনীতিবাদী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি| তিনি রাষ্ট্রকে অটুট রাখতে চেয়েছিলেন| তাঁর এই বিখ্যাত পরিকল্পনাই "মেটারনিক পদ্ধতি বা মেটরনিখ প্রণালী " নামে পরিচিত|

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "Revolution and counter revolution in germany" তে মন্তব্য করেছেন যে, মেটারনিকের ব্যবস্থা হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যে মূলত দুটি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করেছিল-
1.সামন্ত প্রভু
2.মজুতদার পুঁজিপতি শ্রেণী


পদক্ষেপ গ্রহণ

তিনি নিজ পদ্ধতিকে সফল করার তাগিদে ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন| তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করেছিলেন এবং সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন, এমনকি সাহিত্য ও সংস্কৃতির অধিকার হরণ করেছিলেন| গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রতিবাদ দমন করার জন্য তিনি একটি দক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন|



মেটরনিখের নীতি

মেটরনিখ ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করতেন না| ক্যাথলিক চার্চ ও হ্যাপসবার্গ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করাই ছিল তাঁর শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য| একদল রক্ষণশীল ধর্মযাজকের হাতে তিনি রাষ্ট্রের শিক্ষার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন|


কার্লসবাড ডিক্রি

1815 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উদারনীতিবাদ ও জাতীয়তাবাদ প্রভাব বিস্তার করেছিল| এই দুই আদর্শে প্রভাবিত হয়ে জার্মানির বিপ্লবী ছাত্ররা সমাজ ব্যবস্থার স্মারকগুলি আক্রমণ করতে আরম্ভ করেছিল| 1819 খ্রিস্টাব্দের জনৈক রক্ষণশীল গুপ্তচর আন্দোলনকারী ছাত্রদের হাতে নিহত হন| এই ঘটনাকে মেটরনিখ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন|

তিনি "কার্লসবাড ডিক্রি" বা হুকুমনামা জারি করে উদারনীতিবাদ এবং জাতীয়তাবাদকে জার্মানি থেকে নির্মূল করতে চেয়েছিল| এই ডিক্রি জারি করে বলা হল যে, জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অধ্যাপকদের উপর পুলিশ কড়া নজর রাখবে|সংবাদপত্রের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না|

জার্মানিতে বিপ্লবী কার্যাবলী বন্ধ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং বলা হয় যে, কোন অধ্যাপক বিপ্লবী কার্যাবলিতে ছাত্রদের প্ররোচিত করলে, সেই অধ্যাপককে চরম শাস্তি দেওয়া হবে| আরও ঘোষণা করা হল যে, রাজতন্ত্রের নীতি বিরোধী কোন সংবিধানকে গ্রহণ করা হবে না|


ইতালি

ক্লেমেন্স-ভন-মেটরনিখ-এবং-তার-মেটরনিখ-প্রণালী

বর্তমানে ইতালির অবস্থান


ইতালিতেও মেটরনিখ একই ধরনের দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন| হ্যাপসবার্গ শাসিত ভেনিস, লম্বাদিলম্বার্ডি প্রভৃতি অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করা হয়|

1821 খ্রিস্টাব্দে নেপলস এর রাজার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন দেখা দেয়| ট্রপৌ সম্মেলনে মেটরনিখ সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাজতন্ত্রের স্বার্থে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে| এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ট্রিয়ার সৈন্যবাহিনী ইতালিতে অনুপ্রবেশ করে নেপলস গণ আন্দোলন দমন করে|


পোল্যান্ড

ক্লেমেন্স-ভন-মেটরনিখ-এবং-তার-মেটরনিখ-প্রণালী

বর্তমানে পোল্যান্ডের অবস্থান


1830 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অস্ট্রিয়া অধিকৃত পোল্যান্ডের একদল অভিজাত এবং কিছু জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন| তাদের প্রতিবাদ ছিল মূলত হ্যাপসবার্গ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে| 1846 খ্রিস্টাব্দে এ আন্দোলন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ছিল| তখন ধূর্ত মেটরনিখ অভিজাতদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে এই আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল| তারপর পোল্যান্ডের এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নির্দয়ভাবে দমন করা হয়েছিল|


বলকান অঞ্চল

বলকান অঞ্চলে তুরস্কের সুলতানের বিরুদ্ধে 1820 দশকে গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল| রাজতন্ত্রের স্বার্থে গোড়া ক্যাথলিক মেটরনিখ গ্রীকদের বিরুদ্ধে তুরস্কের মুসলিম সুলতানকে সমর্থন করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি|

এঙ্গেলস বলেছেন, "মেটরনিখের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী| একদিকে তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপের অধিকাংশ জাতিকে অস্ট্রিয়ার শাসনাধীন রাখতে এবং অন্যদিকে তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপের সর্বত্র রাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম কায়েম করতে"|



বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত

মেটারনিক ব্যবস্থা ছিল অবশ্যই একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা| এই ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি| মেটানিক পদ্ধতির মূল ভিত্তি ছিল নিষিদ্ধকরণ, তাই অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই ব্যবস্থাকে একটি নেতিবাচক ও সুবিধাবাদী বন্দোবস্ত বলে অভিহিত করেছেন|

ঐতিহাসিক লিপসনের মতে, "মেটরনিখ পুরাটন সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংস কিসুদিন বিলম্বিত করেছিলেন মাত্র, কিন্তু সেটাকে এড়াতে পারেননি"| এইচ. এ. এল. ফিশারের মতে, "বিপ্লবী ও স্বৈরতন্ত্রের মাঝামাঝি কোন পন্থা তিনি খুঁজে পাননি|

সাম্প্রতিককালে কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য একটি নতুন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন| তারা মেটরনিখকে একজন ইউরোপীয় বলে দেখাতে চেয়েছেন, যিনি বিপ্লবের আঘাত থেকে ইউরোপকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন| কিন্তু তার রক্ষণশীলতাকে কোনমতেই ব্যক্তি মানুষের প্রতি মানবিক শ্রদ্ধা বলে বর্ণনা করা যায় না| স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতি, জনতার সার্বভৌমত্বের প্রতি তার গভীর বিতৃষ্ণা ছিল| মুক্তপন্থী, বিপ্লবী, জাতীয়তাবাদী লেখকের কাছে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ও রাজনৈতিক স্বৈরাচারের প্রধান সমর্থক তার বেশি কিছু নন|

ডেভিড টমসন বলেছেন, "ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তীকালে ইউরোপে যখন একটা পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল, তখন তিনি একটি মুমূর্ষু ও ভঙ্গুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিলেন|


উপসংহার

ক্লেমেন্স-ভন-মেটরনিখ-এবং-তার-মেটরনিখ-প্রণালী

বর্তমানে অস্ট্রিয়ার অবস্থান


1848 খ্রি: বিপ্লব মেটারনিক পদ্ধতি  বা  মেটরনিখ  প্রণালীকে খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল| বিপ্লবীদের দাপটে তিনি অস্ট্রিয়া থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন|

ফরাসি বিপ্লব যে একটি নতুন ইউরোপের জন্ম দিয়েছে- এই সত্য ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখ উপলব্ধি করেনি| 1848 খ্রিস্টাব্দে তার পদ্ধতি চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ার পরেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, "আমি এই পৃথিবীতে হয় খুব আগে, না হয় খুব পরে জন্মগ্রহণ করেছি, সমসাময়িক মানুষ আমার মূল্য বুঝিনি"|



তথ্যসূত্র

  1. অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
  2. Adam Zamoyski, "Rites of Peace: The Fall of Napoleon and the Congress of Vienna".
  3. George Holmes, "The Oxford History of Medieval Europe".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐