ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই এর বিখ্যাত মন্ত্রী কোলবাট মন্তব্য করেছিলেন যে, "অর্থের উৎস বাণিজ্য এবং যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু হল অর্থ"| কোলবাটের এই মন্তব্য থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে মার্কেন্টাইলবাদের বৈশিষ্ট্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়|
অ্যাডাম স্মিথ তাঁর "wealth of Nation" গ্রন্থে মার্কেন্টাইলবাদ কথাটি প্রথম ব্যবহার করে| হেনরি পিরেনের মতে, মার্কেন্টাইলবাদের উৎপত্তি ইউরোপে দেখা গিয়েছিল চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে|
অ্যাডাম স্মিথ
Source- wikipedia (check here)
Modified- colour and background
License- creative commons
|
মার্কেন্টাইলবাদ বা মার্কেন্টাইল নীতি বলতে কি বুঝায়
সহজ ভাষায় মার্কেন্টাইলবাদ বলতে বোঝায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ|
এই কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজ দেশে অধিক পরিমাণ সম্পদ আহরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়| পরবর্তীকালে অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও নজর দেওয়া হয়েছিল|
এই নীতি অনুসারে রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমদানির তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে নিজেদের অনুকূলে বাণিজ্যিক ভারসাম্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল|
মার্কেন্টাইলবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য
মার্কেন্টাইলবাদী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন| দেশকে শিল্পপণ্য উৎপাদনের স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে এবং দেশের সমৃদ্ধির উৎপন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানী করতে হবে| শিল্পের পাশাপাশি দেশকে কৃষি উৎপাদনেও স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে|
কৃষি দেশে মানুষের খাদ্য শস্যের যোগান দেবে এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করবে| তবে এই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বাণিজ্য| বাণিজ্য এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যাতে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি পায়|
এজন্য উপনিবেশ স্থাপন করে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে হবে| আমদানি পণ্যের উপর অধিকহারে শুল্ক বসিয়ে দেশের শিল্পকে রক্ষা করা ছিল এর নীতি| উপনিবেশ স্থাপন ও রক্ষার জন্য নৌবহর গঠন করা ছিল জরুরি|
এজন্য উপনিবেশ স্থাপন করে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে হবে| আমদানি পণ্যের উপর অধিকহারে শুল্ক বসিয়ে দেশের শিল্পকে রক্ষা করা ছিল এর নীতি| উপনিবেশ স্থাপন ও রক্ষার জন্য নৌবহর গঠন করা ছিল জরুরি|
মার্কেন্টাইলবাদের লক্ষ্য
মার্কেন্টাইলবাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ গড়ে তোলা| ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন ও পর্তুগাল এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তাদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল|
প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব উপনিবেশগুলোতে একচেটিয়া বাণিজ্য গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল| ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি একদিকে উপনিবেশগুলি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করত এবং অন্যদিকে নিজেদের দেশে তৈরি পণ্যগুলি চড়া দামে উপনিবেশগুলি বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করত|
মাতৃভূমির স্বার্থে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ উপনিবেশগুলিকে অবাধ শোষণ ও লুন্ঠন করার নীতি নিয়েছিল| ফলে অষ্টাদশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন উপনিবেশগুলিতে অধিকার কায়েম করার জন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে উদ্ভব হয়েছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ|
মার্কেন্টাইল নীতির প্রধান অঙ্গ এবং উদ্দেশ্য
গোড়ার দিকে পর্তুগালে মার্কেন্টাইল নীতির প্রধান অঙ্গই ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে মশলা ব্যবসায়ী একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করা| এক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় হল্যান্ড|
সপ্তদশ শতকের গোড়ার থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরদার হয় এবং 1640 থেকে 1641 সালে ওলন্দাজরা পর্তুগীজদের অধিকৃত অঞ্চল সংগ্রহের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং মালাক্কা পর্যন্ত তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে| এই প্রতিযোগিতার ফলে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে পর্তুগালরা বিদায় নিতে বাধ্য হয় এবং ওলন্দাজরা মশলা ব্যবসায়ী একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে|
ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের মধ্যে ঔপনিবেশিক সংঘাত
এরপর পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মশলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ওলন্দাজ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘাত শুরু হয়| এই সংঘাত "অ্যামবয়নার" হত্যাকাণ্ডে চরম রূপ নেয়| অ্যামবয়নার এক সাজানো ষড়যন্ত্রের অজুহাতে 10 জন ইংরেজ কর্মচারীকে হত্যা করে| এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে|
ক্রমওয়েল হল্যান্ডের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে এবং 1651 খ্রিস্টাব্দে নেভিগেশন আইন এর মাধ্যমে ওলন্দাজরা যে বাণিজ্য পণ্য ইংল্যান্ডে নিয়ে আসত তার উপর ইংল্যান্ডে একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করা হয়| ইংল্যান্ডে পণ্য বহনের ক্ষেত্রে শুধু ইংরেজদের অনুমতি দান করা হয়|
এভাবে ওলন্দাজদের সাথে ব্যবসা করে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়| এরই পরিণতি ছিল 1652-59 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ডাচ যুদ্ধ| যুদ্ধের ফলাফল কোন পক্ষের অনুকূলে না গেলেও হল্যান্ডেরই ক্ষতি হয়েছিল বিরাট| সন্ধির শর্তানুসারে হল্যান্ড ইংল্যান্ডে নেভিগেশন আইনের শর্তাদি মেনে নিতে বাধ্য হয়|
দ্বিতীয় চার্লস এর আমলে হল্যান্ডের সঙ্গে আবার 1664-67 খ্রিস্টাব্দে সংঘর্ষ শুরু হয়| যুদ্ধের শেষে ইংল্যান্ড হল্যান্ডের কাছ থেকে নিউ আমস্টারডাম লাভ করে| এর কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় চার্লস ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই এর সাথে যোগ দিয়ে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেকে যুক্ত করেন| কিন্তু পরে চতুর্দশ লুইয়ের আগ্রাসনে আকাঙ্ক্ষিত ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড পুনরায় বিরোধ তুলে দিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একজোট হয়|
মশলার বাজার |
ক্রমওয়েল হল্যান্ডের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে এবং 1651 খ্রিস্টাব্দে নেভিগেশন আইন এর মাধ্যমে ওলন্দাজরা যে বাণিজ্য পণ্য ইংল্যান্ডে নিয়ে আসত তার উপর ইংল্যান্ডে একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করা হয়| ইংল্যান্ডে পণ্য বহনের ক্ষেত্রে শুধু ইংরেজদের অনুমতি দান করা হয়|
এভাবে ওলন্দাজদের সাথে ব্যবসা করে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়| এরই পরিণতি ছিল 1652-59 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ডাচ যুদ্ধ| যুদ্ধের ফলাফল কোন পক্ষের অনুকূলে না গেলেও হল্যান্ডেরই ক্ষতি হয়েছিল বিরাট| সন্ধির শর্তানুসারে হল্যান্ড ইংল্যান্ডে নেভিগেশন আইনের শর্তাদি মেনে নিতে বাধ্য হয়|
দ্বিতীয় চার্লস এর আমলে হল্যান্ডের সঙ্গে আবার 1664-67 খ্রিস্টাব্দে সংঘর্ষ শুরু হয়| যুদ্ধের শেষে ইংল্যান্ড হল্যান্ডের কাছ থেকে নিউ আমস্টারডাম লাভ করে| এর কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় চার্লস ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই এর সাথে যোগ দিয়ে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেকে যুক্ত করেন| কিন্তু পরে চতুর্দশ লুইয়ের আগ্রাসনে আকাঙ্ক্ষিত ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড পুনরায় বিরোধ তুলে দিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একজোট হয়|
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে উপনিবেশিক দ্বন্দ্ব
এরপরে 1688 খ্রিস্টাব্দে গৌরবময় বিপ্লবের সূত্র ধরে দ্বিতীয় জেমস এর কন্যা মেরি ও জামাতা হল্যান্ডের যুবরাজ তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সিংহাসন আহরণ করেন| হল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজা হিসাবে উইলিয়ামের সাথে ফ্রান্সে চতুর্দশ লুইয়ের শত্রুতা ছিল অতি স্বাভাবিক| এইভাবে 1688 থেকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের যৌথ এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম শুরু হয়|
এই সংগ্রামের অন্যতম বিষয় ছিল ফ্রান্স না ইংল্যান্ড কোন শক্তি ভারত ও আমেরিকায় প্রাধান্য স্থাপন করবে| ফরাসি মন্ত্রী কোলবাটের সকল বাণিজ্য ও উপনিবেশ নীতির অনিবার্য পরিণাম ছিল ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের সংঘাত| জনৈক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং উভয় পক্ষই আমেরিকায় পরস্পরের বিজিত অঞ্চল ফিরিয়ে দেয়|
অবশেষে 1763 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সমাপ্তির পর প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে ভারত ও আমেরিকাতে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে|ইংল্যান্ড পৃথিবীর প্রধানতম বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে|
সুতরাং সঙ্গত কারণেই Devid ও Ogg বলেছেন যে, "সপ্তদশ শতকে ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপে যে যুদ্ধগুলি ঘটেছিল, সেগুলি আদৌও ধর্মীয় যুদ্ধ বা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত যুদ্ধ ছিল না| যুদ্ধগুলি ছিল মার্কেন্টাইলবাদ নামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি"|
এই সংগ্রামের অন্যতম বিষয় ছিল ফ্রান্স না ইংল্যান্ড কোন শক্তি ভারত ও আমেরিকায় প্রাধান্য স্থাপন করবে| ফরাসি মন্ত্রী কোলবাটের সকল বাণিজ্য ও উপনিবেশ নীতির অনিবার্য পরিণাম ছিল ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের সংঘাত| জনৈক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং উভয় পক্ষই আমেরিকায় পরস্পরের বিজিত অঞ্চল ফিরিয়ে দেয়|
অবশেষে 1763 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সমাপ্তির পর প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে ভারত ও আমেরিকাতে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে|ইংল্যান্ড পৃথিবীর প্রধানতম বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে|
সুতরাং সঙ্গত কারণেই Devid ও Ogg বলেছেন যে, "সপ্তদশ শতকে ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপে যে যুদ্ধগুলি ঘটেছিল, সেগুলি আদৌও ধর্মীয় যুদ্ধ বা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত যুদ্ধ ছিল না| যুদ্ধগুলি ছিল মার্কেন্টাইলবাদ নামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি"|
উপসংহার
সেই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, মার্কেন্টাইলবাদ অবশ্যই উগ্র জাতীয়তাবাদ ও আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির জন্ম দিয়েছিল|তথ্যসূত্র
- Elena Scarfagna Rossi, "mercantilism in the Europe of the 1990S: A brief essay".
- Phillip J. Smith, "The Rise And Fall Of The British Empire: Mercantilism, Diplomacy And The Colonies".
সম্পর্কিত বিষয়
- মার্কেন্টাইলবাদ কি এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপের এর প্রভাব (আরো পড়ুন)
- মার্টিন লুথার এবং ইউরোপের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন (আরো পড়ুন)
- কৃষি মূলধন ও শিল্প মূলধনের মধ্যে পার্থক্য (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................