রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মুক্ত হাওয়া জীবনের যেদিকগুলিকে সর্বাধিক আন্দোলিত করেছিল, তাদের মধ্যে উন্নত হল সাহিত্য ও শিল্প| বস্তুত পঞ্চদশ শতকের পরবর্তীকালে আধুনিক সাহিত্য ও শিল্পরসের উদ্ভব ঘটে| আবার নবজাগরণের ফলে জন্ম নেই মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ| এর উপরেই ভিত্তি করেই সাহিত্য বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়|
গীর্জার নিয়ন্ত্রণমুক্ত ধর্মীয় বিশ্বাসে না দেখা, না জানা বিষয় বস্তুকে পরিত্যাগ করে সাহিত্য ও শিল্পরস হয়ে উঠে প্রকৃত অর্থেই জীবনমুখী| "শিল্পের জন্য শিল্প"- এই বোধ শিল্পকলার জগতে নিয়ে আসে অভূতপূর্ব বৈচিত্র ও প্রাণ স্পন্দন|
নবজাগরণের যুগে মানবতাবাদী(আরো পড়ুন) তথা জীবনমুখী সাহিত্য চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা| নবজাগরণের মাতৃভূমি ইতালির মানবতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন দুরান্তে দেইলি আলিগিয়েরি বা দান্তে| তিনি ইতালি ভাষায় "লা ভিতা", "ইল কনভিভিও", "দ্যা ডিভাইন কমেডি" প্রভৃতি রচনা করে কাব্য চর্চাকে নতুন গতি প্রদান করেন|
আর এক সাহিত্যিক পেত্রার্ক(Francesco petrarca) "লে রাইম" ও "ট্রাম্পাস" গ্রন্থ দ্বয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসাকে তুলে ধরেছিলেন| তাঁর জীবনমুখী সাহিত্য রচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক ডুরান্ট(W. Durant) বলেছেন, "পেত্রার্ক ছিলেন প্রথম মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ, যিনি মানুষের জীবনকে ভিত্তি করে সাহিত্য সৃষ্টির অধিকার প্রথম প্রচার করেন"|
পেত্রার্ক এর সমসাময়িক বোকাচিও(Boccaccio) লিখেছেন "ডেকামেরন", আর ম্যাকিয়াভেলি রচনা করেছিলেন "দ্য প্রিন্স" ও "ডিসকোর্সেস"| এছাড়াও রেনেসাঁ যুগের ইতালির কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত হলেন লুইগি পুলসি, লোকোভিকো এবং এরিযোস্টো|
ইটালির উর্বর ভূমিতে সাহিত্য নবজীবন লাভ করে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে| পরে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও অনুভূত হয় তার প্রাণ স্পন্দন| আর জার্মান নাট্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান নেই রোজেন প্লুট, হান্স, ব্রান্ট প্রমুখ| তবে ইংল্যান্ডের ইরাসমাস হলেন খুবই পরিচিত নাম| তাই এই সময় গাওয়ার ও চসার ছাড়া বড় কবি ছিলো না| গদ্য সাহিত্যে কিন্তু তেমন উন্নত হয়নি| তবে জনসন এবং শেক্সপিয়ার নাটক লিখে মানুষের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছেন| তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইতালির রেনেসাঁসের হাওয়া জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের উপর পড়লেও পশ্চিম ইউরোপের বাইরে এর প্রভাব পড়েনি|
মানুষ, ঈশ্বর সৃষ্টির নিয়ে চিন্তাভাবনা সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়| আবার রেনেসাঁ সাহিত্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে উৎসাহ দিয়েছিল এবং সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হয়| তাছাড়া রেনেসাঁ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো "রোমান্টিক প্রেমের ধারণা"| আর রেনেসাঁ সাহিত্যই রাজনীতি, অর্থনীতি, ভৌগোলিক আবিষ্কার ও নব জাতীয়তাবাদ, বুর্জোয়াদের উত্থান ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় এবং এইভাবে জন্ম হয় আধুনিক সাহিত্যের|
.......................................
গীর্জার নিয়ন্ত্রণমুক্ত ধর্মীয় বিশ্বাসে না দেখা, না জানা বিষয় বস্তুকে পরিত্যাগ করে সাহিত্য ও শিল্পরস হয়ে উঠে প্রকৃত অর্থেই জীবনমুখী| "শিল্পের জন্য শিল্প"- এই বোধ শিল্পকলার জগতে নিয়ে আসে অভূতপূর্ব বৈচিত্র ও প্রাণ স্পন্দন|
রেনেসাঁস মূর্তি |
রেনেসাঁ সাহিত্য আন্দোলন
পঞ্চদশ শতকের শেষ এবং ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ ছিল ইউরোপের সংস্কৃতির যুগসন্ধিক্ষণ| এই যুগসন্ধিক্ষণে ইউরোপের সাহিত্যিকরা একই সঙ্গে ল্যাটিন ও মাতৃভাষা চর্চা করেন| ধ্রুপদী গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের আঙ্গিক শৈলী অনুভূতি ও সৌন্দর্য বোধ রেনেসাঁস সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল| এই যুগেই সাহিত্যিক রচনা করেন কবিতা, নাটক ও গদ্য সাহিত্য| এর সঙ্গে ছিল রোমান মহাকাব্য ও চারণ কবিদের গাঁথা|নবজাগরণের যুগে মানবতাবাদী(আরো পড়ুন) তথা জীবনমুখী সাহিত্য চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা| নবজাগরণের মাতৃভূমি ইতালির মানবতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন দুরান্তে দেইলি আলিগিয়েরি বা দান্তে| তিনি ইতালি ভাষায় "লা ভিতা", "ইল কনভিভিও", "দ্যা ডিভাইন কমেডি" প্রভৃতি রচনা করে কাব্য চর্চাকে নতুন গতি প্রদান করেন|
আর এক সাহিত্যিক পেত্রার্ক(Francesco petrarca) "লে রাইম" ও "ট্রাম্পাস" গ্রন্থ দ্বয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসাকে তুলে ধরেছিলেন| তাঁর জীবনমুখী সাহিত্য রচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক ডুরান্ট(W. Durant) বলেছেন, "পেত্রার্ক ছিলেন প্রথম মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ, যিনি মানুষের জীবনকে ভিত্তি করে সাহিত্য সৃষ্টির অধিকার প্রথম প্রচার করেন"|
পেত্রার্ক এর সমসাময়িক বোকাচিও(Boccaccio) লিখেছেন "ডেকামেরন", আর ম্যাকিয়াভেলি রচনা করেছিলেন "দ্য প্রিন্স" ও "ডিসকোর্সেস"| এছাড়াও রেনেসাঁ যুগের ইতালির কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত হলেন লুইগি পুলসি, লোকোভিকো এবং এরিযোস্টো|
ইটালির উর্বর ভূমিতে সাহিত্য নবজীবন লাভ করে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে| পরে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও অনুভূত হয় তার প্রাণ স্পন্দন| আর জার্মান নাট্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান নেই রোজেন প্লুট, হান্স, ব্রান্ট প্রমুখ| তবে ইংল্যান্ডের ইরাসমাস হলেন খুবই পরিচিত নাম| তাই এই সময় গাওয়ার ও চসার ছাড়া বড় কবি ছিলো না| গদ্য সাহিত্যে কিন্তু তেমন উন্নত হয়নি| তবে জনসন এবং শেক্সপিয়ার নাটক লিখে মানুষের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছেন| তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইতালির রেনেসাঁসের হাওয়া জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের উপর পড়লেও পশ্চিম ইউরোপের বাইরে এর প্রভাব পড়েনি|
মানুষ, ঈশ্বর সৃষ্টির নিয়ে চিন্তাভাবনা সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়| আবার রেনেসাঁ সাহিত্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে উৎসাহ দিয়েছিল এবং সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হয়| তাছাড়া রেনেসাঁ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো "রোমান্টিক প্রেমের ধারণা"| আর রেনেসাঁ সাহিত্যই রাজনীতি, অর্থনীতি, ভৌগোলিক আবিষ্কার ও নব জাতীয়তাবাদ, বুর্জোয়াদের উত্থান ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় এবং এইভাবে জন্ম হয় আধুনিক সাহিত্যের|
রেনেসাঁ শিল্প আন্দোলন
সাহিত্যের মতো শিল্পেও নবজাগরণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়| মধ্যযুগের শিল্পকলার গতি সাবলীল ছিল না, ছিল গতানুগতিক| কিন্তু নবজাগরণ সেই গতানুগতিককে ভেঙে দিয়ে নিয়ে আসে জীবনমুখী শিল্পচর্চা এবং নিষ্প্রাণ শিল্পচর্চা হয় প্রাণস্বচ্ছল| এর সাথে নর-নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিভিন্ন রূপ, জীব-জন্তু, নদী-পাহাড় ইত্যাদি উপর ভিত্তি করে শুরু হয় নতুন জীবনের ধারনা এবং শিল্পের প্রস্ফুটিত হয় চলমান বস্তুর জীবন ও জগতের ছবি|
সাহিত্যের মতো শিল্পেও নবজাগরণের পথ প্রদর্শক ছিল ইতালির ফ্লোরেন্স নগরী| ফ্লোরেন্সের চিত্রবিদ জিওটি-কে চিত্রাঙ্কনে নবজাগরণের আদি রূপকার বলা হয়| ফ্লোরেন্সের বাত্তিসেলী জীবনমুখী চিত্রাঙ্কন করে চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসে নবযুগের প্রবর্তন করেন| স্থাপত্যবিদ ব্রামানটি রোমের সেন্ট পিটার গির্জায় তার আধুনিক স্থাপত্য ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলেন| টাইটিয়ান চিত্রায়িত করেছিলেন "The Three Ages of Man".
মোনালিসা |
দ্য লাস্ট সাপার বা শেষ নৈশভোজ |
নবজাগ্রত সংস্কৃতির স্রষ্টা এবং শিল্প ও চিত্রকলার প্রধান চরিত্র হলো লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো বা মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল বা রাফায়েল্লো| ভিঞ্চির দুটি কালজয়ী সৃষ্টি হল "মোনালিসা" এবং "দ্য লাস্ট সাপার" বা "শেষ নৈশভোজ" এবং তাঁর ছবিতে কোন মধ্যযুগীয় বাহুল্য নেই| চিত্রায়িত চরিত্রগুলির প্রতিকৃতি এবং ব্যাক্তিত্ব এখানে শিল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল|
যাকে আমরা "High Renaissance Art" বলি তার দ্বিতীয় আকর্ষণীয় ব্যক্তি হলেন মাইকেলেঞ্জেলো| সিসটাইন চ্যাপেলের "The Creation of Adam" নামে যে দেওয়াল চিত্রটি তিনি এঁকেছিলেন সেখানে মানুষের নগ্ন প্রকৃতির মধ্যে মানুষের জীবন শক্তিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন| আবার ধর্মীয় সংঘাতের ভিত্তিতে তিনি চিত্রায়িত করেছিলেন "শেষ বিচার"(The Last Judgment)|
এই যুগে আর এক অন্যতম এবং স্মরণীয় শিল্পী ছিলেন ইতালির রাফায়েল| তাঁর আঁকা যীশুখ্রীষ্টের মাতা "ম্যাডোনা" চিত্রটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রাঙ্কন হিসেবে বিবেচিত হয়|
এই যুগে আর এক অন্যতম এবং স্মরণীয় শিল্পী ছিলেন ইতালির রাফায়েল| তাঁর আঁকা যীশুখ্রীষ্টের মাতা "ম্যাডোনা" চিত্রটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রাঙ্কন হিসেবে বিবেচিত হয়|
ইতালির মানবতাবাদী(আরো পড়ুন) যুব চেতনার স্ফূরন শুধুমাত্র ইতালিতেই ঘটেছিল, এমনটা ভাবলে খুব ভুল হবে| এই যুগ ভাবনার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের যোগাযোগ ঘটে| এই সময় ইতালিতে যারা বইয়ের ব্যবসা করতে আসতেন এবং বিদ্যার্থীরা পড়াশোনা করতে আসতেন, তারা দেশে ফিরে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপের নতুন চিন্তা-ভাবনার সংযোগ ঘটিয়ে ছিলেন| ঐতিহাসিক Jacob Burckhardt তাঁর গ্রন্থ "The Civilization of the Renaissance in Italy" তে দেখিয়েছেন কীভাবে এই ইতালির সাংস্কৃতিক জীবনকে বিদেশিদের অনেকেই একটি উচ্চতর সভ্যতার নির্ণয় রূপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন|
উপসংহার
তবে পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি যে, রেনেসাঁ শিল্প হল মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান| স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও চিত্রকলার শিল্পীরা পরিপূর্ণ জীবনের জয়গান গেয়েছেন| তবে শিল্পীরা শুকনো বাস্তবকে ধরতে চাননি, তারা বাস্তবকে তাদের আনন্দ ও সৌন্দর্যবোধ অধরা মাধুরীকে ধরেছে| রেনেসাঁ সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সার্থকতা লাভ করেছে এবং সার্থক হয়েছে তাদের এই কালজয়ী চিত্রকলা ও সাহিত্য|
তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
- Jacob Burckhardt, "The Civilization of the Renaissance in Italy".
- Roberta J. M., "The Biography of the Object in Late Medieval and Renaissance Italy".
সম্পর্কিত বিষয়
- রেনেসাঁ ও মানবতাবাদ (আরো পড়ুন)
- নবজাগরণ বা রেনেসাঁ কাকে বলে এবং ইউরোপীয় সমাজের উপর এর প্রভাব .(আরো পড়ুন)
- মার্টিন লুথার এবং ইউরোপের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|