রুশ-জাপান যুদ্ধে(1904-1905 খ্রিস্টাব্দ) রাশিয়ার পরাজয় প্রাচ্যের কোন শক্তির হাতে পাশ্চাত্য কোন জাতির প্রথম পরাজয়| সামরিক শক্তি এবং রাষ্ট্রের আয়তনের দিক থেকে বিচার করলে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে বেশ ভালো পার্থক্য ছিল এবং এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাপানের রণ কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়|
যুদ্ধে প্রভূত্ব কর্তৃত্বের পরিচয় দিলেও জাপান অন্তত ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তার পক্ষে যুদ্ধ জয়ের সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করার মত মানসিকতা তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না| অপরদিকে রাশিয়ার আবার নতুন করে জাপানের বিরুদ্ধে সমর সজ্জা শুরু করলে, সুদূর প্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে যুক্ত রাষ্ট্রের নেত্রী মন্ডলী উভয়কে পোর্টসমাউথের সন্ধি আলোচনার জন্য আহ্বান করেন|
পোর্টসমাউথের চুক্তি
শেষ পর্যন্ত উভয়ের দেশের মধ্যে 1905 খ্রিস্টাব্দে 5 ই সেপ্টেম্বর পোর্টসমাউথের চুক্তি সম্পাদিত হয়| এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি হল-
- কোরিয়ায় জাপানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রাধান্য স্বীকৃতি লাভ করবে|
- রাশিয়া লিয়াওতুং উপদ্বীপের অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়|
- মাঞ্চুরিয়া রেলপথের দক্ষিণ অঞ্চলের উপরে জাপানের কর্তৃত্ব স্বীকৃতি হয়|
চুক্তির শর্ত সম্পর্কে আলোচনার প্রথম দিকে জাপান প্রচুর ক্ষতিপূরণ দাবি করে| কিন্তু চুক্তি স্থাপনের পরিবর্তে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণায় রাশিয়ার মনোভাব সম্পর্কে আভাস পাওয়ার ফলে জাপান চুক্তির অন্যান্য শর্ত রাশিয়ার পক্ষ থেকে স্বীকৃতি হয় এবং ক্ষতিপূরণের দাবি পরিত্যাগ করলে রাশিয়া এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়|
রুশ জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের কারণ
প্রথমত- রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল জাতীয় চেতনার অভাব| সুদূর প্রাচ্যের এই যুদ্ধকে রাশিয়ার জনগণ কখনোও সমর্থন করতে পারিনি এবং স্বদেশ থেকে বহুদূরে এই যুদ্ধকে কখনোই তারা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি|
দ্বিতীয়ত-
স্বদেশ থেকে বহুদূরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফলে রাশিয়ার পক্ষে সঠিক ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি| যদিও অতি-সাইবেরীয় রেলপথ বা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে সাহায্যে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটি এত ব্যয় সাপেক্ষ ছিল যে, রাশিয়ার পক্ষে মোটেও উপযুক্ত ছিল না|
তৃতীয়ত- জাপানের স্থল ও নৌবাহিনীর তুলনায় রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী অনেক দুর্বল ছিল| ফলে সংখ্যায় তাদের আধিক্য থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনীয় বীরত্বের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়|
চতুর্থত- জাপানের পক্ষে এই যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক, কিন্তু রাশিয়ার নিকট এই যুদ্ধ ছিল আক্রমণাত্মক ও সাম্রাজ্যবাদীতার ফল| সুতরাং জাপানের সৈন্যবাহিনী দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকলেও, ভাড়াটে যোদ্ধাদের মত রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী শুধুমাত্র সরকারি নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করেই সন্তুষ্ট ছিল| ফলে তাদের পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা কোন ক্রমেই সম্ভব ছিল না|
তার সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, রুশ-জাপান যুদ্ধ এর পরবর্তীকালে যে সব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলিকে অনেকটাই আমরা জাতীয়তাবাদের লক্ষণ, ভাবধারা এবং তার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করে থাকি| এরই ফলশ্রুতি স্বরূপ ইউরোপের জাতীয়তাবাদী জনগণ দেশের প্রতি জাতীয়তাবাদের জন্য আত্ম বলিদানে নিজেকে উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র পিছু পা হাঁটেনি- যেটি একটি ইউরোপের ইতিহাসের যুদ্ধের মূল স্রোত বা ধারা হওয়া উচিত|
.......................................
প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধকে জনসাধারণ জারের দরবারে কয়েকজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নিজ উদ্দেশ্য সাধনের উপায় রূপে বিবেচনা করত| পোর্ট আর্থার বন্দরের পতনের সময় এই বিষয়টি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল| তিন মাসের রসদ এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মজুত থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী জাপানের নিকট আত্মসমর্পণের বাধ্য হয়|
দ্বিতীয়ত-
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে |
স্বদেশ থেকে বহুদূরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফলে রাশিয়ার পক্ষে সঠিক ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি| যদিও অতি-সাইবেরীয় রেলপথ বা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে সাহায্যে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটি এত ব্যয় সাপেক্ষ ছিল যে, রাশিয়ার পক্ষে মোটেও উপযুক্ত ছিল না|
তৃতীয়ত- জাপানের স্থল ও নৌবাহিনীর তুলনায় রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী অনেক দুর্বল ছিল| ফলে সংখ্যায় তাদের আধিক্য থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনীয় বীরত্বের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়|
চতুর্থত- জাপানের পক্ষে এই যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক, কিন্তু রাশিয়ার নিকট এই যুদ্ধ ছিল আক্রমণাত্মক ও সাম্রাজ্যবাদীতার ফল| সুতরাং জাপানের সৈন্যবাহিনী দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকলেও, ভাড়াটে যোদ্ধাদের মত রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী শুধুমাত্র সরকারি নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করেই সন্তুষ্ট ছিল| ফলে তাদের পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা কোন ক্রমেই সম্ভব ছিল না|
উপসংহার
রুশ-জাপান যুদ্ধ তৎকালীন সময়ে ইউরোপ তথা বিশ্ব জগতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিল| কারণ এই যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, দেশের প্রতি প্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং আনুগত্য না থাকলে কোন দেশের পক্ষে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে জয় লাভ করা সম্ভব নয়|তার সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, রুশ-জাপান যুদ্ধ এর পরবর্তীকালে যে সব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলিকে অনেকটাই আমরা জাতীয়তাবাদের লক্ষণ, ভাবধারা এবং তার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করে থাকি| এরই ফলশ্রুতি স্বরূপ ইউরোপের জাতীয়তাবাদী জনগণ দেশের প্রতি জাতীয়তাবাদের জন্য আত্ম বলিদানে নিজেকে উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র পিছু পা হাঁটেনি- যেটি একটি ইউরোপের ইতিহাসের যুদ্ধের মূল স্রোত বা ধারা হওয়া উচিত|
তথ্যসূত্র
- ড. হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, "জাপানের ইতিহাস"
- R. H. P. Mason, "A History of Japan".
- Kenneth Henshall, "A History of Japan: From Stone Age to Superpower".
সম্পর্কিত বিষয়
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|