জার্মানির পরাজয়ের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে, আবার যুদ্ধোত্তর বিশ্বের সংকট শুরু হয় জার্মানিকে কেন্দ্র করেই| যুদ্ধ যখন শেষ হওয়ার মুখে তখনও পর্যন্ত পরাজিত জার্মানি সম্বন্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষে সর্বসম্মত কোন নির্দিষ্ট নীতিতে নির্ধারিত হতে পারিনি| সাময়িকভাবে দেশটিকে কয়েকটি সামরিক দখলভুক্ত এলাকায় ভাগ করা হলেও স্থির হয়েছিল (জুলাই 1945, পটসডাম সম্মেলন) যে, জার্মানির ঐক্য বজায় রাখা হবে|
তবে তার ভারী শিল্প ও অস্ত্র উৎপাদনের কারখানাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সমস্ত রকম নাৎসি সংগঠন ও কার্যকলাপ হবে বেআইনি| কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানির রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি| জার্মানির ভাগ্য নির্ধারণকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় মহাদেশে এক জটিল সংকট সৃষ্টি হয় এবং কমিউনিস্ট রাশিয়া ও পাশ্চাত্য শিবিরের মধ্যে গভীর মতবিরোধ দেখা দেয়|
কমিউনিস্ট রাশিয়া ও পাশ্চাত্য শিবিরের মধ্যে গভীর মতবিরোধ
সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিতে একটি কেন্দ্রীভূত সরকার স্থাপনের পক্ষপাতী ছিল এবং জার্মানির সম্পদ আহরণ করে সোভিয়েত অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছিল| অধ্যাপক আইজাক ডয়েশার বলেছেন, "সোভিয়েত নেতারা জার্মানিতে এমন এক সরকার চেয়েছিলেন, যা হবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া প্রভৃতির মতোই সোভিয়েত উপগ্রহ বিশেষ| পক্ষান্তরে জার্মানিতে একটি গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় বিধি-ব্যবস্থা স্থাপনের নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য ছিল"|
একদিকে 1946 সালের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অধিকৃত পূর্ব জার্মান অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য দলগুলিকে উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়| সোশালিস্ট দলকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত করে "সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি" গঠিত হয়|
একদিকে 1946 সালের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অধিকৃত পূর্ব জার্মান অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য দলগুলিকে উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়| সোশালিস্ট দলকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত করে "সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি" গঠিত হয়|
পশ্চিম জার্মানি
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভুত্ববাদী নীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়| 1946 সালে স্টুটগার্টে এক ভাষণে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জেমস এফ. বইরনেস(James Francis Byrnes) তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছিলেন-- মার্কিন সেনা ইউরোপীয় মহাদেশে বহাল থাকবে|
- পশ্চিম জার্মানির অঞ্চলগুলির আর্থিক উন্নয়নের জন্য দৃষ্টি দেওয়া হবে এবং এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিন অধিকৃত ভূখণ্ড দুটি একটি সুসংহত অর্থনৈতিক বলয় হিসেবে ধর্মীয় আর্থিক ও শিল্প নীতি অনুসরণ করবে|
- বইরনেস জার্মান জনগণকে স্বশাসনের অধিকার দানের অঙ্গীকার করলেন|
এদিকে পশ্চিম জার্মানিতে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হলে স্তালিন আশঙ্কিত হয়| পশ্চিমাঞ্চলের স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থার সঙ্গে পূর্ব জার্মানির সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মুদ্রা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের অর্থনীতি বেহাল হয়ে পড়বে|
পূর্ব জার্মানি
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পূর্ব জার্মানির সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্যভাগে অবস্থিত বার্লিন শহরের সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির ভৌগলিক যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেই এবং বার্লিন অবরোধ শুরু হয় (জুলাই, 1948)| সোভিয়েত ইউনিয়ন বার্লিন অবরোধের মাধ্যমে পশ্চিমী শক্তিবর্গের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল| সোভিয়েত চাপের কাছে নতি স্বীকার করে হয়তো পশ্চিমী দেশগুলি বার্লিন শহরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিবে, নতুবা পশ্চিম জার্মানিতে নতুন রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে সচেষ্ট হবে না|
মার্কিন সামরিক কর্ণধার জেনারেল ক্লে কোনমতেই সোভিয়েত চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না| তাঁর মতে, যদি সময়মতো সুদৃঢ় পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়, তাহলে সাম্যবাদের প্রসার ভয়াবহ আকার ধারণ করবে|
বার্লিন অবরোধ
বার্লিন অবরোধের ফলে পশ্চিম বার্লিনের 2.5 মিলিয়ন জনসাধারণের জীবনধারা সংকটের সম্মুখীন হয়| কারণ স্থলপথে পশ্চিম জার্মানি থেকে পূর্ব জার্মানির সোভিয়েত কর্তৃত্বাধীন অঞ্চল অতিক্রম করে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না|স্বভাবতই আকাশপথে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়| এক বছর ধরে অবিরাম আকাশপথে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী সরবরাহ অব্যাহত থাকে| শেষ পর্যন্ত বার্লিন অবরোধের উপযোগিতা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়| বার্লিন অবরোধের ফলে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে| অবশেষে 1949 সালে 12 ই মে সোভিয়েত রাশিয়া বার্লিন অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়|
বার্লিন অবরোধের পর পশ্চিমী শক্তিবর্গ দুই ধরনের কার্যকলাপ গ্রহণ করে|
- প্রথমত রাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমী শক্তিবর্গ ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসি অঞ্চলগুলিকে একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নেই| এর ফলে 1949 সালে 21শে মে "পশ্চিম জার্মান রাষ্ট্র" বা "জার্মান ফেডারেল রিপাবলিক" এর আত্মপ্রকাশ ঘটে| 1949 সালে আগস্ট মাসে নির্বাচনে খ্রিস্টান ডেমোক্রেটস(Christian Democrats) দল জয় লাভ করে এবং এই দলের নেতা কনরাড আদিনর(Konrad Adenauer) পশ্চিম জার্মানির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন|
- সামরিক দিক থেকে বার্লিন অবরোধ পাশ্চাত্য মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করে| এই প্রথম সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়| এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রমূখ দেশগুলি পশ্চিম ইউরোপের যৌথ নিরাপত্তা বলবৎ করার জন্য 1949 সালের এপ্রিল মাসে ন্যাটো (NATO) নামে সামরিক জোট গঠন করে|
পূর্ব জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ
বার্লিন অবরোধের ব্যর্থতা ও পশ্চিম জার্মান রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ জার্মানি সম্বন্ধে স্তালিনের নীতিতে পরিবর্তন ঘটায়| 1949 সালের অক্টোবরে পূর্ব জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়| অটো গ্রোটোহল(Otto Grotewohl) হলেন নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধার হন|
সরকারের দায়িত্ব "সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি" এর উপর ন্যস্ত ছিল এই দলের নেতা ছিলেন ওয়াল্টার উলব্রিকট(Walter Ulbricht) 12 বছর পরে 1961 সালে পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিট প্রাচীর গড়ে তোলেন এবং জার্মানির রাজনৈতিক বিভাজন সম্পূর্ণ হয়|
এতদিন পর্যন্ত স্তালিন ঐক্যবদ্ধ জার্মানির উপর সোভিয়েত প্রভুত্ব স্থাপনের আগ্রহী ছিলেন এবং পরিস্থিতির চাপে তাকে সেই লক্ষ্য থেকে পরে সরে আসতে হয়|
.......................................
সরকারের দায়িত্ব "সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি" এর উপর ন্যস্ত ছিল এই দলের নেতা ছিলেন ওয়াল্টার উলব্রিকট(Walter Ulbricht) 12 বছর পরে 1961 সালে পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিট প্রাচীর গড়ে তোলেন এবং জার্মানির রাজনৈতিক বিভাজন সম্পূর্ণ হয়|
এতদিন পর্যন্ত স্তালিন ঐক্যবদ্ধ জার্মানির উপর সোভিয়েত প্রভুত্ব স্থাপনের আগ্রহী ছিলেন এবং পরিস্থিতির চাপে তাকে সেই লক্ষ্য থেকে পরে সরে আসতে হয়|
উপসংহার
জার্মান সমস্যা শুধুমাত্র নিছক জার্মানির রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উপর নির্ভরশীল ছিল না, সার্বিক মার্কিন-সোভিয়েত সংঘাতের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল| তবে শেষ পর্যন্ত 28 বছর পরে 1989 খ্রিস্টাব্দে 9 ই নভেম্বর এই বেড়া ভেঙে দেওয়া হয় এবং 1990 খ্রিস্টাব্দে 3 রা অক্টোবর দুই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়|তথ্যসূত্র
- Pavneet Singh, "International Relations".
- Ghosh Peu, "International Relations".
সম্পর্কিত বিষয়
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় উপনিবেশবাদের পতন তথা এর গুরুত্ব (আরো পড়ুন)
- ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|