মোগল বা মুঘল শাসন ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারি ব্যবস্থার প্রচলন। সম্রাট আকবরের সময় এই ব্যবস্থা সুসংহত রূপ লাভ করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয়। অবশ্য এই ব্যবস্থায় আকবরের সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্ভাবন নয়, মধ্য এশিয়া অঞ্চলে প্রায় এই ধরনের ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু ছিল।
আকবর সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি দূর করে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য 1577 খ্রিস্টাব্দে(তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে এই সালটিকে নিয়ে) এই মনসবদার ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটান। মুঘল আমলে প্রশাসনিক পদ হিসাবে মনসবদার শব্দটি পাওয়া যায়। মনসব কথাটির অর্থ হল এক কথায় "পদমর্যাদা"। সাধারণভাবে পদাধিকারী কর্মী গোষ্ঠী মনসব নামে অভিহিত হত।
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র, Source-(check here) |
✍️মনসবদারী ব্যবস্থা প্রবর্তনে আকবরের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা ঐতিহাসিক আরভিন বলেছেন, এগুলি হল-
- মনসবের অধিকারীকে মুঘল সম্রাটের কর্মচারী রূপে প্রমাণিত করা।
- পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদারদের বেতন নির্দিষ্ট করা।
- মনসবদারদের নির্দিষ্ট সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী রাখা এবং প্রয়োজনে সম্রাটকে সাহায্য করতে বাধ্য করা। তবে অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায় অবশ্য মনে করেন যে, মনসব কথাটি অলৌকিক। কারণ সকল কর্মচারীর সামরিক পদক্ষেপ থাকলেও সবার ক্ষেত্রে সামরিক কর্তব্য বাধ্যতামূলক ছিল না।
যুদ্ধ |
মনসবদার পদে মনোনয়নের জন্য সম্রাটের ইচ্ছা ছিল শেষ কথা। উচ্চ কর্মচারীদের সুপারিশকে সাধারণভাবে সম্রাট মর্যাদা দিতেন। নিয়মানুযায়ী মীরবক্সী মনসব প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে সম্রাটের কাছে পেশ করতেন। সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীদের সাহায্যের পর তার সিদ্ধান্ত জানাতেন। সম্রাটের অনুমোদিত নামগুলি দেওয়ান ও মীরবক্সীর কার্যালয়ে নথিভুক্ত করা হতো, এরপর উজির মনসব প্রার্থীদের নিয়োগপত্র প্রদান করতেন।
"আইন-ই-আকবরী" গ্রন্থে আবুল ফজল 66টি স্তর উল্লেখ করেছেন, আবার একই গ্রন্থে সমকালীন মনসবদারদের নাম ও বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি 33টি স্তরের কথা জানিয়েছেন।
অধ্যাপক এ.সি. ব্যানার্জি মনে করেন যে, "সম্ভবত আকবর 66 টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত 33টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন"। সাধারণভাবে 5 হাজারের উপরে মনসবগুলি সাধারণত রাজপুতদের দেওয়া হতো। তবে মান সিংহ, টোডরমল, কুঁলি খা সম্রাটের প্রতি বিশ্বাস ভাজন হওয়ায় "সব হাজারী মনসবদারি" দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। মুঘল যুগে মনসবদারদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানি, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত ও মারাঠি।
রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে আকবর মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও আধুনিক গবেষকদের মতে এটি বিভিন্ন পর্যায় সংশোধিত হয়ে 1593 খ্রিস্টাব্দের নাগাদ পূর্ণ রূপ নিয়ে ছিলো। প্রাথমিকভাবে এতে বিভিন্ন মনসবদারদের সৈন্য সংখ্যা ও পদমর্যাদা নির্দিষ্ট করা ছিল, কিন্তু অধিকাংশ মনসবদার নির্দিষ্ট চেয়ে কম সৈন্য রাখতেন। এই ত্রুটি দূর করার জন্য রাজত্বের 40 তম এই ব্যবস্থায় জাট ও সওয়ার নামে দুটি পদের প্রবর্তন করেন। জাট ও সওয়ার পদে ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
ব্লকমনের মতে, "জাট হল মনসবদারদের অধীনস্থ সৈন্য সংখ্যা এবং সওয়ার হল অশ্ব সংখ্যা"। আরভিন এবং আব্দুল আজিজ মতে, "জাট হল অশ্বারোহী সেনা ও সওয়ার হলো অতিরিক্ত সেনা"। আবার অধ্যাপক R. P. Tripathi মনে করেন যে, সওয়ার হলো মনসবদারদের বাড়তি মর্যাদা। Ashirbadi Lal Srivastava মত পোষণ করেছেন যে, জাট ও সওয়ার হল পদমর্যাদা সূচক।
✍️জাট ও সওয়ার ব্যাখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মনসবদারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
অধ্যাপক এ.সি. ব্যানার্জি মনে করেন যে, "সম্ভবত আকবর 66 টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত 33টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন"। সাধারণভাবে 5 হাজারের উপরে মনসবগুলি সাধারণত রাজপুতদের দেওয়া হতো। তবে মান সিংহ, টোডরমল, কুঁলি খা সম্রাটের প্রতি বিশ্বাস ভাজন হওয়ায় "সব হাজারী মনসবদারি" দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। মুঘল যুগে মনসবদারদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানি, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত ও মারাঠি।
রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে আকবর মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও আধুনিক গবেষকদের মতে এটি বিভিন্ন পর্যায় সংশোধিত হয়ে 1593 খ্রিস্টাব্দের নাগাদ পূর্ণ রূপ নিয়ে ছিলো। প্রাথমিকভাবে এতে বিভিন্ন মনসবদারদের সৈন্য সংখ্যা ও পদমর্যাদা নির্দিষ্ট করা ছিল, কিন্তু অধিকাংশ মনসবদার নির্দিষ্ট চেয়ে কম সৈন্য রাখতেন। এই ত্রুটি দূর করার জন্য রাজত্বের 40 তম এই ব্যবস্থায় জাট ও সওয়ার নামে দুটি পদের প্রবর্তন করেন। জাট ও সওয়ার পদে ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
ব্লকমনের মতে, "জাট হল মনসবদারদের অধীনস্থ সৈন্য সংখ্যা এবং সওয়ার হল অশ্ব সংখ্যা"। আরভিন এবং আব্দুল আজিজ মতে, "জাট হল অশ্বারোহী সেনা ও সওয়ার হলো অতিরিক্ত সেনা"। আবার অধ্যাপক R. P. Tripathi মনে করেন যে, সওয়ার হলো মনসবদারদের বাড়তি মর্যাদা। Ashirbadi Lal Srivastava মত পোষণ করেছেন যে, জাট ও সওয়ার হল পদমর্যাদা সূচক।
✍️জাট ও সওয়ার ব্যাখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মনসবদারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
- যেসব মনসবদারদের জাট ও সওয়ার সংখ্যা সমান, তাদের প্রথম শ্রেণীর মনসবদার বলা হয়।
- সওয়ারের সংখ্যা জাটের সংখ্যার অর্ধেক, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর মনসবদার।
- আর তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন সেইসব মনসবদার, যাদের সওয়ারের সংখ্যা ছিল জাট সংখ্যার অর্ধেকেরও কম।
পদাতিক সৈন্য |
মনসবদাররা সৈন্য সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিতেন। মূলত নির্দিষ্ট ভাতা থেকে তাদের অস্ত্র কিনতে হত। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের জন্য এককালীন অর্থ মঞ্জুর করত। প্রতি বছর বা প্রতি তিন বছর অন্তত তার বাহিনীকে সম্রাট বা সেনাধ্যক্ষের সামনে পরিদর্শনের জন্য হাজির করতে বাধ্য থাকতেন। মনসবদারদের বেতন হত দুইভাবে- নগদে ও জমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে। যারা নগদে বেতন পেত, তাদের বলা হতো মনসবদারি নগদী এবং যারা নির্দিষ্ট জমি রাজস্বের অধিকারী হতেন, তারা জায়গীরদার নামে পরিচিত হন। তবে মনসবদাররা সাধারণভাবে বংশানুক্রমিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না।
👉প্রথমত- মুঘল মনসবদাররা রাষ্ট্রকে নানাভাবে প্ররোচনা করত। সমকালীন লেখক বদাউনি লিখেছেন যে, এরা যেকোন লোককে সরকারি পরিদর্শনের সময় সৈনিক হিসেবে দেখিয়ে নির্দিষ্ট ভাতা আত্মসাৎ করত। অনেক ক্ষেত্রে এরা নিম্নমানের ঘোড়া রাখত এবং সৈনিকদের ব্যক্তিগত প্রতিভার ও উদ্যোগে এই ত্রুটি দূর হলেও পরবর্তীকালে উচ্চাসী শাসকের অভাবে তা প্রবল ভাবে প্রকাশিত হয়, যা সমগ্র প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়।
👉দ্বিতীয়ত- মুঘল সৈন্য বাহিনী ছিল কার্যত মনসবদারদের অধীন। আকবরের সময় কিছু মনসবদারদের বদলি করা হলেও পরবর্তীতে এই বদলি ব্যবস্থা উঠে যায়। অন্যান্য মুঘল সৈন্যরা অনুগত থাকতো মনসবদারদের প্রতি, সম্রাটের প্রতি নয়। উপরন্ত সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সৈন্য নিয়োগ ও বেতনের দায়িত্ব নিলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়।
তৃতীয়ত- আকবর এই ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি নগদ বেতন ব্যবস্থার উপর জোর দেন। কিন্তু পরবর্তীতে অদূরদর্শিতায় জায়গীর প্রদান প্রথা ব্যাপকত্ব লাভ করে, যা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাই।
✍️সর্বোপরি মুঘল সম্রাটেরা মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকায় দুই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়-
✍️জায়গিরদারি প্রথা এবং পরবর্তীকালে জায়গির সংকট
আকবরের শাসনকালে মনসবদারি ব্যবস্থা তার ব্যক্তিগতভাবে দক্ষতায় সাফল্য লাভ করেছিল। তা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থার কিছু অন্তর্নিহিত ত্রুটি ছিল। যা আকবরের পরবর্তীকালে বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে সরাসরি প্রকাশিত হয়ে মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি করেছিল।👉প্রথমত- মুঘল মনসবদাররা রাষ্ট্রকে নানাভাবে প্ররোচনা করত। সমকালীন লেখক বদাউনি লিখেছেন যে, এরা যেকোন লোককে সরকারি পরিদর্শনের সময় সৈনিক হিসেবে দেখিয়ে নির্দিষ্ট ভাতা আত্মসাৎ করত। অনেক ক্ষেত্রে এরা নিম্নমানের ঘোড়া রাখত এবং সৈনিকদের ব্যক্তিগত প্রতিভার ও উদ্যোগে এই ত্রুটি দূর হলেও পরবর্তীকালে উচ্চাসী শাসকের অভাবে তা প্রবল ভাবে প্রকাশিত হয়, যা সমগ্র প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়।
👉দ্বিতীয়ত- মুঘল সৈন্য বাহিনী ছিল কার্যত মনসবদারদের অধীন। আকবরের সময় কিছু মনসবদারদের বদলি করা হলেও পরবর্তীতে এই বদলি ব্যবস্থা উঠে যায়। অন্যান্য মুঘল সৈন্যরা অনুগত থাকতো মনসবদারদের প্রতি, সম্রাটের প্রতি নয়। উপরন্ত সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সৈন্য নিয়োগ ও বেতনের দায়িত্ব নিলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়।
তৃতীয়ত- আকবর এই ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি নগদ বেতন ব্যবস্থার উপর জোর দেন। কিন্তু পরবর্তীতে অদূরদর্শিতায় জায়গীর প্রদান প্রথা ব্যাপকত্ব লাভ করে, যা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাই।
✍️সর্বোপরি মুঘল সম্রাটেরা মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকায় দুই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়-
- অস্বাভাবিক হারে বর্ধিত মনসবদারদের দাবি মেটানোর জন্য বহু খাস জমিকে জায়গীর জমিতে রুপান্তর করতে হয় এবং সরকারের আয় কমে যায়।
- নবীনযুক্ত মনসবদারদের অনেকেই জায়গীর জমি স্বল্পতার জন্য জমি পেতে বহুদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
পরিশেষে আমরা এই কথা বলতে পারি যে, এই জায়গির সংকট মুঘল শাসনের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলে ছিল।
............ সমাপ্ত............
👉তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
✍️সম্পর্কিত বিষয়
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন🙏।
......................................................