মুঘল শাসনতান্ত্রিক সংগঠন এবং সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করত সম্রাটের ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর। আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মুঘল সম্রাটরা দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের সাহায্যে সাম্রাজ্যের ঐক্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে আওরঙ্গজেব এর রাজত্বকালের অন্তিম লগ্নে সাম্রাজ্যে সাংগঠনিক দিকগুলো ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারী পক্ষে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
তবে আওরঙ্গজেব এর রাজত্বকালের অন্তিম লগ্নে সাম্রাজ্যে সাংগঠনিক দিকগুলো ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারী পক্ষে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্Date- 26 September 2015 Source- wikipedia (check here) |
এই পতনকে অনেকটাই ত্বরান্বিত করে ছিল, মুঘল রাজ দরবারে অভিজাতদের মধ্যে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও দলাদলি। সতীশ চন্দ্র ও আতাহার আলী দেখিয়েছেন যে, মুঘল দরবারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে জায়গিরদারি সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং উৎকৃষ্ট জায়গির জন্য তাদের মধ্যে রেষারেষি মুঘল শাসক শ্রেণীর মধ্যে সুপ্ত বিভাজক শক্তিগুলিকে জাগিয়ে তুলেছিল। দরবারে সবথেকে প্রভাবশালী দলে সমর্থকদের মধ্যে উৎকৃষ্ট জায়গিরগুলি বন্টন হত। সব দলই চাইতো ওয়াজির বা মীর বক্সীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল অভিজাতরা প্রধানত তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, যথা- ইরানি, তুরানি, হিন্দুস্তানি। ইরানি দলের নেতা ছিলেন আসদ খান এবং তার পুত্র জুলফিকার খান। তুরানি দলের নেতা ছিলেন ফিরোজ জঙ্গ এবং তার পুত্র চিনকিলিস খান। হিন্দুস্তানি দলের নেতা ছিলেন আফগান নেত্রিবৃন্দ, সৈয়দ ভ্রাতৃবৃন্দ এবং খান-ই-দোরান এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দ। সতীশ চন্দ্র বলেছেন, দলগুলি জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি, দলগুলির মূল ভিত্তি ছিল পাস্পরিক সম্পর্কে, ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এবং সর্বোপরি স্বার্থবোধ।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত গৃহযুদ্ধের সময় মুনিম খান দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। দিল্লির সিংহাসনে বসার পর বাহাদুর শাহ আসদ খানের স্থানে মুনিম খানকে ওয়াজির পদে নিযুক্ত করেন। আসদ খানকে লাহোর ও দিল্লির সুবেদার পদে নিযুক্ত করা হয় এবং চিনকিলিস খানকে সাত হাজারি মনসবদারি পদে নিযুক্ত করা হয়। ফিরোজ জঙ্গ গুজরাটে শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। এই অবস্থায় তুরানি গোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেই।
1711 খ্রিস্টাব্দে মুনিম খানের মৃত্যু হলে ওয়াজির পদ দখলের লড়াই নতুন করে আরম্ভ হয়। প্রধান দাবিদার জুলফিকার খানের বিরোধী ছিল শাহজাদা আজিজ-উস-খান| 1712 খ্রিস্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার অপর তিন পুত্রদের জুলফিকার আজিজ উস খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেন। আজিজ-উস-খান নিহত হওয়ার পর জুলফিকার খান জাহান্দর শাহকে সিংহাসনে বসলেন এবং তিনি নিজে ওয়াজির পদের দায়িত্ব নেন এবং জুলফিকার খান প্রকৃত শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
জাহান্দর শাহের আমলে মুঘল দরবারে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ ধারণ করে। ওয়াজিরকে সরানোর জন্য জাহান্দর শাহ গোপন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেই। এই কাজে তিনি সঙ্গী হিসাবে পান মীর বক্সী, কোকলাতাস ও তার অনুগামীদের। সতীশ চন্দ্র বলেছেন, এর ফলে এক দূষিত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর প্রভাব প্রত্যেকটি বিভাগে পড়েছিল। এই অবস্থায় 1713 খ্রিস্টাব্দে ফারুকসিয়া জাহান্দর শাহকে পরাস্ত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ফারুকসিয়া তার সাহায্যকারী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ সৈয়দ আব্দুল খাকে ওয়াজির এবং সৈয়দ হুসেন আলীকে মীর বক্সী বলে বসানো হয়। এর ফলে দরবারে হিন্দুস্তানি গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তুরানি গোষ্ঠীর নেতাদের সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম থেকেই ফারুকসিয়া তাদের তাদের সম্পর্কে তিক্ত হয়ে উঠে। ফারুকশিয়ার দুই প্রিয় পাত্র মীর জুমলা ও খান-ই-দোরানের শহীদ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হন। তাই ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র লিখেছেন যে, "এই সময়ের ইতিহাস ছিল ফারুকসিয়া ও সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষমতার একটানা সংকটের ইতিহাস'। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরানি, তুরানি ও অভিজাত গোষ্ঠী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং উৎকৃষ্ট জায়গির জন্য তাদের মধ্যে রেষারেষি মুঘল শাসক শ্রেণীর মধ্যে সুপ্ত বিভাজক শক্তিগুলিকে জাগিয়ে তুলেছিল। দরবারে সবথেকে প্রভাবশালী দলে সমর্থকদের মধ্যে উৎকৃষ্ট জায়গিরগুলি বন্টন হত। সব দলই চাইতো ওয়াজির বা মীর বক্সীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে।
যুদ্ধ পতাকা, সাম্রাজ্য সীল, জাতীয় পতাকা
Author- Santosh.mbahrm
Date- 26 September 2015
Source- wikipedia (check here)
License- GNU Free Documentation License
|
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল অভিজাতরা প্রধানত তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, যথা- ইরানি, তুরানি, হিন্দুস্তানি। ইরানি দলের নেতা ছিলেন আসদ খান এবং তার পুত্র জুলফিকার খান। তুরানি দলের নেতা ছিলেন ফিরোজ জঙ্গ এবং তার পুত্র চিনকিলিস খান। হিন্দুস্তানি দলের নেতা ছিলেন আফগান নেত্রিবৃন্দ, সৈয়দ ভ্রাতৃবৃন্দ এবং খান-ই-দোরান এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দ। সতীশ চন্দ্র বলেছেন, দলগুলি জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি, দলগুলির মূল ভিত্তি ছিল পাস্পরিক সম্পর্কে, ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এবং সর্বোপরি স্বার্থবোধ।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত গৃহযুদ্ধের সময় মুনিম খান দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। দিল্লির সিংহাসনে বসার পর বাহাদুর শাহ আসদ খানের স্থানে মুনিম খানকে ওয়াজির পদে নিযুক্ত করেন। আসদ খানকে লাহোর ও দিল্লির সুবেদার পদে নিযুক্ত করা হয় এবং চিনকিলিস খানকে সাত হাজারি মনসবদারি পদে নিযুক্ত করা হয়। ফিরোজ জঙ্গ গুজরাটে শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। এই অবস্থায় তুরানি গোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেই।
1711 খ্রিস্টাব্দে মুনিম খানের মৃত্যু হলে ওয়াজির পদ দখলের লড়াই নতুন করে আরম্ভ হয়। প্রধান দাবিদার জুলফিকার খানের বিরোধী ছিল শাহজাদা আজিজ-উস-খান| 1712 খ্রিস্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার অপর তিন পুত্রদের জুলফিকার আজিজ উস খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেন। আজিজ-উস-খান নিহত হওয়ার পর জুলফিকার খান জাহান্দর শাহকে সিংহাসনে বসলেন এবং তিনি নিজে ওয়াজির পদের দায়িত্ব নেন এবং জুলফিকার খান প্রকৃত শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
জাহান্দর শাহের আমলে মুঘল দরবারে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ ধারণ করে। ওয়াজিরকে সরানোর জন্য জাহান্দর শাহ গোপন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেই। এই কাজে তিনি সঙ্গী হিসাবে পান মীর বক্সী, কোকলাতাস ও তার অনুগামীদের। সতীশ চন্দ্র বলেছেন, এর ফলে এক দূষিত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর প্রভাব প্রত্যেকটি বিভাগে পড়েছিল। এই অবস্থায় 1713 খ্রিস্টাব্দে ফারুকসিয়া জাহান্দর শাহকে পরাস্ত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ফারুকসিয়া তার সাহায্যকারী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ সৈয়দ আব্দুল খাকে ওয়াজির এবং সৈয়দ হুসেন আলীকে মীর বক্সী বলে বসানো হয়। এর ফলে দরবারে হিন্দুস্তানি গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তুরানি গোষ্ঠীর নেতাদের সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম থেকেই ফারুকসিয়া তাদের তাদের সম্পর্কে তিক্ত হয়ে উঠে। ফারুকশিয়ার দুই প্রিয় পাত্র মীর জুমলা ও খান-ই-দোরানের শহীদ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হন। তাই ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র লিখেছেন যে, "এই সময়ের ইতিহাস ছিল ফারুকসিয়া ও সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষমতার একটানা সংকটের ইতিহাস'। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরানি, তুরানি ও অভিজাত গোষ্ঠী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
📝তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"।
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"।
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"।
📝সম্পর্কিত বিষয়
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)।
- মনসবদারি ব্যবস্থা এবং পরবর্তীকালে জায়গির সংকট (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
......................................................