আওরঙ্গজেব বা ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি পূর্ববর্তী সম্রাটদের দাক্ষিণাত্য সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতির পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে। দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত থাকার সময়ে আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডা ও বিজাপুর রাজ্য দুটি মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার উপক্রম করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সাফল্য পাননি।
এরপর রাজত্বকালে প্রথমার্ধে তিনি উত্তর ভারতের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টি প্রদান করার মত সময় তার ছিল না। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি দাক্ষিণাত্যের রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এই অবস্থাই আওরঙ্গজেব নিজেই দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রাজস্বের শেষ 26 বছর সম্রাটের সকল শক্তি গোলকুন্ডা ও বিজাপুর বিলুপ্তির সাধন করতে এবং মারাঠাদের ধ্বংস সাধন করতে নিয়োজিত হয়। গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল-
- উভয় ছিল শিয়া রাষ্ট্র, সুতরাং সুন্নি মুঘল সাম্রাজ্যের পরম শত্রু।
- চুক্তি অনুযায়ী তাদের কর বাকি ছিল।
- তারা দিল্লির মুঘল সম্রাটকে উপেক্ষা করে পারস্যের সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত ইত্যাদি।
👉বিজাপুরের পতন
1784 খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ মুয়াজ্জেম আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তিনি যুদ্ধ না করে বিজয়পুরের সুলতানের সঙ্গে সন্ধি করেন। 1785 খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব বিজয়পুরের সুলতানের কাছে একটি ফরমান পাঠিয়ে সুলতান সাবাজ খানের পদচ্যুতি এবং 5-6 হাজার অশ্বারোহী দাবি করে।
কিন্তু সুলতান সম্রাটের দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে বিজাপুর রাজ্যে যেসকল স্থানে মুঘলরা ইতিপূর্বে দখল করেছিল, সেইগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এই অবস্থায় 1686 খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব নিজেই বিজাপুরের সুলতান আদিন শাহকে বন্দী করেন।
কিন্তু সুলতান সম্রাটের দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে বিজাপুর রাজ্যে যেসকল স্থানে মুঘলরা ইতিপূর্বে দখল করেছিল, সেইগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এই অবস্থায় 1686 খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব নিজেই বিজাপুরের সুলতান আদিন শাহকে বন্দী করেন।
যুদ্ধ পতাকা, সাম্রাজ্য সীল, জাতীয় পতাকা, Source-(check here) |
👉গোলকুন্ডার পতন
বিজয়পুরের পর গোলকুন্ডার দিকে দৃষ্টি পড়ে। গোলকুন্ডার বিরুদ্ধে সম্রাটের বিশেষ কতগুলি অভিযোগ ছিল, যেমন-
- মুসলমান প্রজাবর্গের উপর গোলকুন্ডার হিন্দু মন্ত্রীদের অত্যাচার।
- গোলকুন্ডার সুলতান গোপনে মুঘলদের বিরুদ্ধে শম্ভুজীকে সাহায্য করতেন।
গোলকুন্ডার সুলতান আবুল হাসান বিরক্তের সঙ্গে সম্রাটকে বাধা প্রদান করেন। আব্দুল্লা পানি নামে গোলকুন্ডার এক কর্মচারীর বিশ্বাস ঘাতকতায় গোলকুন্ডা অতি সহজে আওরঙ্গজেব দখল করে।
👉আওরঙ্গজেব ও মারাঠা
আওরঙ্গজেব তার দাক্ষিণাত্য অভিযানে দুটি মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল গোলকুন্ডা ও বিজাপুর দখল এবং দ্বিতীয়টি হল মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া। দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত থাকার সময় আওরঙ্গজেব শিবাজীকে দমন করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি সায়েস্তা খাঁকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন, কিন্তু সায়েস্তা খাঁ ব্যর্থ হয়।
আবার আওরঙ্গজেব জয় সিংকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। জয় সিং(আরো পড়ুন) এর অনুরোধে শিবাজী মুঘল দরবারে আগমন করলে শিবাজীকে নজর বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে শিবাজী নিজ বুদ্ধির জন্য সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
গোলকুন্ডা ও বিজাপুর বিজিত হওয়ায় আওরঙ্গজেব মারাঠাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তিমান হন। ইতিমধ্যে শিবাজীর পুত্র শম্ভুজী সিংহাসনে বসেন। 1689 খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের আক্রমণে তিনি বিপর্যস্ত হন এবং বিধর্মী ও বিদ্রোহী অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আওরঙ্গজেবের আদেশে নিহত হন।
কিন্তু আমরা ইতিহাস পাঠক হিসাবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এই ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব এক মারাত্মক ভুল করেছিলেন। এই নেতৃত্ব বিহীন মারাঠারা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে পাগলের মতো মুঘল রাজ্যে লুটপাট করতে থাকে।
অন্যদিকে আওরঙ্গজেব সর্বশক্তি দিয়ে মারাঠাদের দুর্গগুলি দখল করতে থাকে। বন্যা, মহামারী ও মারাঠাদের আক্রমণ থেকে মুঘল বাহিনীকে কোনদিনও শান্তি দেয়নি। 1703 খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব মারাঠাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং তিনি মুঘলদের হাতে বন্দি শম্ভুজীর পুত্র শাহজী ও তার মাকে মুক্ত করতে রাজি হন। প্রকৃত পক্ষে তিনি বহু চেষ্টা করলেও মারাঠা শক্তিকে বিধ্বস্ত করতে ব্যর্থ হন।
তার দাক্ষিণাত্য নীতির সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। অ্যাডাম স্মিথ, এলফিনস্টোন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের বিলুপ্তি সাধন করে আওরঙ্গজেব অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মতে-
শিবাজীর মূর্তি |
আবার আওরঙ্গজেব জয় সিংকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। জয় সিং(আরো পড়ুন) এর অনুরোধে শিবাজী মুঘল দরবারে আগমন করলে শিবাজীকে নজর বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে শিবাজী নিজ বুদ্ধির জন্য সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
গোলকুন্ডা ও বিজাপুর বিজিত হওয়ায় আওরঙ্গজেব মারাঠাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তিমান হন। ইতিমধ্যে শিবাজীর পুত্র শম্ভুজী সিংহাসনে বসেন। 1689 খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের আক্রমণে তিনি বিপর্যস্ত হন এবং বিধর্মী ও বিদ্রোহী অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আওরঙ্গজেবের আদেশে নিহত হন।
কিন্তু আমরা ইতিহাস পাঠক হিসাবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এই ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব এক মারাত্মক ভুল করেছিলেন। এই নেতৃত্ব বিহীন মারাঠারা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে পাগলের মতো মুঘল রাজ্যে লুটপাট করতে থাকে।
অন্যদিকে আওরঙ্গজেব সর্বশক্তি দিয়ে মারাঠাদের দুর্গগুলি দখল করতে থাকে। বন্যা, মহামারী ও মারাঠাদের আক্রমণ থেকে মুঘল বাহিনীকে কোনদিনও শান্তি দেয়নি। 1703 খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব মারাঠাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং তিনি মুঘলদের হাতে বন্দি শম্ভুজীর পুত্র শাহজী ও তার মাকে মুক্ত করতে রাজি হন। প্রকৃত পক্ষে তিনি বহু চেষ্টা করলেও মারাঠা শক্তিকে বিধ্বস্ত করতে ব্যর্থ হন।
অ্যাডাম স্মিথ
Source- wikipedia (check here)
|
তার দাক্ষিণাত্য নীতির সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। অ্যাডাম স্মিথ, এলফিনস্টোন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের বিলুপ্তি সাধন করে আওরঙ্গজেব অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মতে-
- গোলকুন্ডা ও বিজাপুর বিজিত হলে তাদের কর্মচ্যুত সৈনিকরা মারাঠা সেনাবাহিনীতে যোগদান করে মারাঠা শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিল।
- আওরঙ্গজেবের উচিত ছিল দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাজ্যগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে মারাঠা শক্তিকে বিধ্বস্ত করা, কিন্তু আওরঙ্গজেব তা না করে খুব ভুল করেছিল।
তবে একথা সত্য যে, আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। দাক্ষিণাত্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় একজনের পক্ষে সমগ্র সাম্রাজ্যের উপর দৃষ্টি রাখা সম্ভব ছিল না। দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার ফলে রাজকোষ একেবারে শূন্য হয়ে পড়ে, এর ফলে চারিদিকে বিদ্রোহ ও অশান্তি দেখা দিয়েছিল।
এই সকল কারনে তাঁর জীবন কালে মুঘল সাম্রাজ্যের বিপর্যয় আরম্ভ হয়।
এই সকল কারনে তাঁর জীবন কালে মুঘল সাম্রাজ্যের বিপর্যয় আরম্ভ হয়।
✍️তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
✅সম্পর্কিত বিষয়
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবান। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
..........................🙏........................