মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা

মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সম্পর্কে বিভিন্ন লেখক ও ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন| আবুল ফজলের(আরো পড়ুন) "আইন-ই-আকবরি", "আকবরনামা" এবং বিদেশি কিছু লেখক ও পর্যটক যথা- বার্নিয়ে, মানুচি প্রভৃতিদের লেখা হতে মুঘল আমলের সামাজিক ও অর্থনীতি জীবন সম্বন্ধে জানা যায়|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা

মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র

Author- Santosh.mbahrm
Date- 26 September 2015
Source- wikipedia (check here)
License- GNU Free Documentation License


মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক অবস্থা

বঙ্গদেশে মুঘল শাসন সামাজিক ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল| স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর "History of Bengal" গ্রন্থে বলেছেন যে, "মুঘল শাসনে যে পরিবর্তনের স্রোত দেখা যায়, তা একমাত্র ব্রিটিশ শাসনে বাংলায় আধুনিকরণের এই রকম গভীর পরিবর্তন দেখা যায়নি"|

এই যুগে বাংলায় অর্থনীতির সমুন্নতির ফলে এবং বিদেশি বণিকদের আপামনের ফলে বাংলার অর্থনীতির জীবনে যে পরিবর্তন এসেছিল, তা বাংলার সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে বাংলার এই বাণিজ্যটিকে কেন্দ্র করে নগরায়নের সূচনা হয় এবং এরফলে বাংলার সমাজ জীবনেও পরিবর্তিত হতে থাকে|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা
রাধা-কৃষ্ণ


এই যুগে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের বন্যা বয়ে যায়| চৈতন্যদেব তার ভক্তি ধর্ম প্রচার করেন এবং রুপ গোস্বামী, জীব গোস্বামী, সনাতন রঘুনাথ ভট্ট প্রমুখেরা ভক্তি ধর্মকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকেন| এসব মহান ঋষিদের প্রচেষ্টায় বাংলার গ্রামে গ্রামে এই ধর্ম মত প্রচার হতে থাকে|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা


এই ধর্মের প্রভাবে জাতিভেদ প্রথার তীব্রতা কমতে থাকে| সমাজের নিম্ন বর্ণের অশিক্ষিত, অবহেলিত শ্রেণীগুলি বৈষ্ণব ধর্মের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তির আশ্বাস পায়| এই  ধর্ম বাংলার সীমানায় দাড়িয়ে মনিপুর, ত্রিপুরা এবং আসামে প্রবেশ করতে থাকে|

বাংলা ধর্ম ছাড়া তান্ত্রিক ধর্ম বিদ্যমান ছিল, এছাড়া ছিলো সহজিয়া সম্প্রদায়| এই সহজিয়ারা বাউল, সাই, দরবেশ প্রভৃতি নানা শাখায় বিভক্ত ছিল| এই সহজিয়া পন্থীরা ব্রাহ্মণদের জাতিভেদ প্রথার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন| সহজিয়া গুরুরা বলেন- "ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি হয়, আবার যদি বেদ পড়লে ব্রাহ্মণ হওয়া যায়, তবে চন্ডালরাও বেদ পড়ুক, তারাও ব্রাহ্মণ হবে"|

নগ্ন সাধুদের সম্পর্কে তারা বলেন, "যদি নগ্ন হলে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে শিয়াল-কুকুর আগেই মুক্তি হবে"| তারা মনে করেন যে, সহজিয়া পন্থা হলো আসল পন্থা এবং এই পন্থাতে গুরুর শিক্ষা ও আশীর্বাদ বিদ্যমান থাকে| সহজিয়ারা শেষ কথা বলেন, ভক্ত ও ভগবানের সহজ সম্পর্কের মধ্যে মুক্তি পাওয়া সম্ভব|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা
Title-সতীদাহ প্রথা 
Author-Frederic Shoberl
Source - wikipedia (check here)
licence- creative commons
Modified- colour and background


বাংলার হিন্দু সমাজে নারী জাতির অবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়| বাল্যবিবাহ, সতীদাহ(আরো পড়ুন) এবং নারীদের শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল| একমাত্র সম্ভ্রান্ত পরিবার ও বৈষ্ণবদের মধ্যে স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন ছিল| সাধারণ হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল যে, নারীরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবে এবং সপ্তম বর্ষের কন্যার বিবাহ দান সমাজের প্রশংসার সহ গণ্য হতো|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা
Source- wikipedia (check here)
Modified- colour and background
licence- creative commons


মুঘল আমলে বঙ্গদেশের ক্রীতদাস প্রথার(আরো পড়ুন) প্রমাণ পাওয়া যায়| সমকালীন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বারবোসা বলেছেন, অভাবের তাড়নায় অনেক পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের খুব অল্প দামে বিক্রি করতো| বাংলার তৎকালীন সমাজ জীবনে বহু দরিদ্র নারীরাও সস্তায় দাসী হিসাবে বিক্রি হতো|

ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি একটি যুবতী ক্রীতদাসী সস্তায় কিনেছিলেন| আবার একটি তথ্য থেকে জানা যায়, মর্জানাথন তার বন্ধুকে মাত্র এক টাকার বিনিময় একটি সুন্দরী নারী ক্রয় করতে দেখেছিলেন| সাহিত্য-সঙ্গীত বিশেষ করে গোপীচন্দ্রের গানে দেখা যায় যে, বিবাহের বিভিন্ন যৌতুকের সঙ্গে দাস-দাসীদের উপহার দেওয়ার রীতি ছিল|

এই আমলে বাংলার সমাজে নীতিবোধ তেমন উন্নত ছিল না| ধনী ব্যক্তিরা অবৈধ কাজ, ব্যভিচার এবং বাইজির নৃত্য-গীতের মগ্ন থাকতেন| বিদেশী লেখক রয়েস্টার বলেছেন- "বাঙালিরা খুব চালাক ছিল, বাঙালির পুরুষরা চুরি-ডাকাতি করত এবং স্ত্রী লোকেরা লজ্জাহীনা ও অসতী ছিল"|

বাঙালি চরিত্রে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একটি প্রচলিত ছড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে- "মারে ঠাকুর বা মারে কুকুর" অর্থাৎ যে মারে তাকে ঠাকুরের মত মান্য করব এবং যে না মারে তাকে কুকুরের মত ঘৃণা করব| ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এটাই বাঙালি চরিত্রের সম্ভাব্য বলে উল্লেখ করেছেন|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা

যুদ্ধ পতাকা, সাম্রাজ্য সীল, জাতীয় পতাকা

Author- Santosh.mbahrm
Date- 26 September 2015
Source- wikipedia (check here)
License- GNU Free Documentation License


তবে এত কিছু খারাপ সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হলেও এটা অবশ্যই আমাদের বলতে হবে যে, এই আমলে বাংলায় মুসলিম ও হিন্দু সমাজের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন ছিল| মা মনসার কোপ থেকে বাঁচার জন্য চাঁদ সদাগর ঘরের মধ্যে পবিত্র কোরআন রেখেছিলেন| এই থেকে অনুমান করা যায়, মুঘল আমলে বাংলার সমাজ যথেষ্ট বিভেদহীন ছিল|


মুঘল আমলে অর্থনৈতিক অবস্থা

এই যুগে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আলোচনা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ| ইবন বতুতা, বারবোসা প্রভৃতি পর্যটকরা বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রশংসা করেছেন| এই আমলে বাংলার অর্থনীতি কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য- এই তিনটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল| "আইন-ই-আকবরি" থেকে জানা যায় যে, বাংলায় চাল এত পরিমান বেশি উৎপন্ন হতো, যা পরবর্তীকালে বাইরে রপ্তানি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না|

খাদ্য দ্রব্যের দামও অত্যন্ত সস্তা ছিল| ইবন বতুতা বলেছেন যে- বঙ্গদেশের একজন বাঙ্গালী বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন, তাদের স্বামী-স্ত্রী এবং ভৃত্যের খাদ্যের জন্য বছরে তিন টাকা খরচ হত|

মুঘল-আমলে-বাংলার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-অবস্থা
রেশম কাপড়


মুঘল যুগে বাংলায় বিভিন্ন ধরনের ধরনের শিল্প উৎপাদিত হতো| বাংলায় রেশম শিল্প ছিল বিখ্যাত শিল্প এবং বাংলায় এত পরিমান রেশম উৎপাদিত হতো যে, তা চীনের রেশম অপেক্ষায় পরিমাণে অনেক বেশি ছিল| তাই ইংরেজ বণিকগণ বস্ত্র শিল্পকে বাংলার জাতীয় শিল্প বলে উল্লেখ করেছেন|

এই বাণিজ্যের মাধ্যমে যে অর্থ আসত, তা শুধুমাত্র ধনী ও উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা ভোগ করত| কৃষকরা তাদের ফসলের ভালো মূল্য পেত না|

খাদ্য দ্রব্যের দাম খুব সস্তা ছিল বলে মুঘল যুগে বঙ্গদেশকে বলা হতো ভারতের স্বর্গ| কিন্তু এই স্বর্গ ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল|

পরিশেষে ঐতিহাসিক মানরিখ বলেছেন- "কৃষকরা কর দিতে না পারায় তাকে বেঁধে বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং পিছনে চলছে সেই কৃষকের কন্দনরত মাতা, স্ত্রী ও শিশুরা, এরকম দৃশ্য গ্রামে প্রায় দেখা যেত"|




তথ্যসূত্র

  1. সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
  3. অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"

    সম্পর্কিত বিষয়

    সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|

                  ......................................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐