মুঘল সরকারের রাজস্বের প্রধান আয় ভূমি রাজস্ব থেকে আদায় হতো| গৌতম ভদ্র এর ভাষায়, "কৃষকরা ছিল মুঘল যুগের শাসক শ্রেণীর বিপুল ঐশ্বর্যের উৎস"| আবার ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন, মুঘল সাম্রাজ্য একটি সমঝোতার উপর দাঁড় করানো ছিল| কৃষকের হাতে জীবন ধারণের মতো কর্মস্থান সম্রাট রাখতেন| তার বাড়তি উৎপাদন সাধ্যমত সংগ্রহ করতেন| মুঘল সাম্রাজ্যের সব অঞ্চলে সমান হারে রাজস্ব আদায় করা হতো না, তবে অধিকাংশ অঞ্চলে উৎপাদনের অর্ধেক রাজস্ব হিসাবে দাবি করা হতো|
মোরল্যান্ড জানিয়েছেন যে, মুঘল যুগের শেষে কৃষকদের উপর রাষ্ট্রের দাবি বৃদ্ধি পেয়েছিল| ভূমি রাজস্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা ধরনের "আব ও ওয়ার বা বেআইনি কর"| মুকুন্দ রামের চন্ডীমঙ্গলে এইসব বেআইনি করের বিস্তারিত বিবরণ আছে| এইসব কর কৃষকদের কাছে বোঝাস্বরূপ হয়ে উঠেছিল|
মুঘল আমলের কৃষিজমি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যেমন-
- খালিসা জমি
- জায়গির জমি
যে জমি থেকে সম্রাটের নিজস্ব আয় আসতো তাকে বলা হতো, খালিসা জমি| আর নগদ বেতনের পরিবর্তে যে জমি মনসবদারদের(আরো পড়ুন) ভোগ দখলের স্বত্ত্বে দেওয়া হতো, তাকে জায়গির জমি বলা হতো|
যারা জায়গির অধিকারী হতেন তাদের জায়গিরদার বলা হতো| এই জায়গিরের উপর জায়গিরদারদের কোন ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতো না| জায়গিরদারদের জায়গির চ্যুত করা বা অন্য জায়গায় বদলি করা ছিল সম্রাটের ইচ্ছাধীন|
অষ্টাদশ শতকে মনসবদারদের সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জায়গির অভাব দেখা দিতে থাকে| অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেছেন যে, "আগে যে জায়গির এক মনসবদারদের পক্ষে যথেষ্ঠ ছিল, তা পরবর্তীকালে একাধিক মনসবদারদেরকে দেওয়া শুরু হয়েছিল"| কাফি খান লিখেছেন যে, "খাতা কলমে পাওয়া মনসবদারদের উপযুক্ত জায়গির পেতে একজন শিশু বৃদ্ধ হয়ে যেত"|
এর ফলে একদিকে যেমন জায়গিরহীন মনসবদার সৃষ্টি হতে থাকে, অন্যদিকে অসংখ্য মনসবদারদের মধ্যে সীমিত পরিমাণ উৎকৃষ্ট জায়গিরের(আরো পড়ুন) জন্য রেষারেষি এক নজিরবিহীন সংকটের সৃষ্টি করে| এই সংকটের কথা বারংবার উল্লেখ পাওয়া যায় সমসাময়িক দলিলে| আওরঙ্গজেব আক্ষেপ করে বলেছেন, "এক আনার সদ বিমার অর্থাৎ একটি বেদনা ও একশত অসুস্থ লোক"|
সমসাময়িক লেখক এনায়েত উল্লা লিখেছেন, "সম্রাটের সম্মুখে উচ্চ পদস্থ লোকদের মিছিল অফুরন্ত, কিন্তু জায়গিরের জন্য নির্দিষ্ট জমি সীমিত"| জায়গির না পাওয়ার জন্য মনসবদারদের শোচনীয় অবস্থার কথা ভিনসেন্ট ও কাফি খান স্পষ্ট জানিয়েছেন|
শাসক শ্রেণীর এই সংকটকালীন অবস্থায় ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্তানিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়| এর ফলে শাসক শ্রেণীর মধ্যে দলাদলি বৃদ্ধি পাই| সব দলই চাইতেন "ওয়াজির বা মির বক্সীর মতো" গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে শাসনতন্ত্রকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে|
উদ্বৃত্ত সম্পদের স্বীয় ভাগ পাওয়ার জন্য শাসক শ্রেণীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কৃষকদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল| ইরফান হাবিব ও গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন যে, এই চাপের ফলে কৃষকরা তাদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান থেকে বঞ্চিত হতেন| জায়গিরদারদের জায়গির দাবিতে কোন স্বত্ত্ব না থাকার ফলে তাদের বদলির হার বাড়তে থাকে| স্বাভাবিকভাবেই জায়গিরদাররা নিজেদের অঞ্চলে কৃষি কাজ সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন না|
এর ফলে জায়গিরদাররা বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করে কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার কর আদায় করতেন| বার্নিয়ে, মানুচি, সাদি খান, ভিনসেন্ট স্মিথ, কাফি খান এরা প্রত্যেকেই কৃষকদের উপর জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন|
জমিদাররা(আরো পড়ুন) প্রায় তাদের জায়গির থেকে নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করতে পারতেন না বলে এই আদায় দায়িত্ব অন্য এক দলের হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতেন, তাদেরকে বলা হতো ইজারাদার| মূলত তাকেই ইজারা দেওয়া হতো যিনি সব থেকে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন|
অধ্যাপক গৌতম ভদ্র এর মতে, এইভাবে কৃষকদের উপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, তাদের কাছে বাঁচার পথ ছিল চাষবাস ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া|
কৃষকদের দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায়ের শুধু ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ| অনেক ক্ষেত্রে কৃষক সমাজের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে সংগঠিত করে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জমিদাররা| কেননা জমিদাররাই প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং তাদের বিভিন্ন অধিকার ও দায়িত্ব ইজারাদাররা আত্মসাৎ করেছিল| এইভাবে বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ মুঘল সমাজের সংহতি ও শক্তির মূলে আঘাত করেছিলো|
এইভাবে মুঘল আমলে শেষ পর্বে সমাজের কৃষি ব্যবসায় এক ব্যাপকভাবে সংকটের সৃষ্টি করেছিল| জমি অনাবাদী হওয়ায় ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের আয় কমতে থাকে| মুঘল আমলে কৃষি সংকট এবং এর পরিণামে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে|
পরিশেষে ইরফান হাবিব বলেছেন, আওরঙ্গজেবের উত্তরসূরিদের আমলে এই সমস্যার তীব্রতা আরও বেড়ে ছিল এবং ক্রমশ তা সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল|
অষ্টাদশ শতকে মনসবদারদের সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জায়গির অভাব দেখা দিতে থাকে| অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেছেন যে, "আগে যে জায়গির এক মনসবদারদের পক্ষে যথেষ্ঠ ছিল, তা পরবর্তীকালে একাধিক মনসবদারদেরকে দেওয়া শুরু হয়েছিল"| কাফি খান লিখেছেন যে, "খাতা কলমে পাওয়া মনসবদারদের উপযুক্ত জায়গির পেতে একজন শিশু বৃদ্ধ হয়ে যেত"|
এর ফলে একদিকে যেমন জায়গিরহীন মনসবদার সৃষ্টি হতে থাকে, অন্যদিকে অসংখ্য মনসবদারদের মধ্যে সীমিত পরিমাণ উৎকৃষ্ট জায়গিরের(আরো পড়ুন) জন্য রেষারেষি এক নজিরবিহীন সংকটের সৃষ্টি করে| এই সংকটের কথা বারংবার উল্লেখ পাওয়া যায় সমসাময়িক দলিলে| আওরঙ্গজেব আক্ষেপ করে বলেছেন, "এক আনার সদ বিমার অর্থাৎ একটি বেদনা ও একশত অসুস্থ লোক"|
সমসাময়িক লেখক এনায়েত উল্লা লিখেছেন, "সম্রাটের সম্মুখে উচ্চ পদস্থ লোকদের মিছিল অফুরন্ত, কিন্তু জায়গিরের জন্য নির্দিষ্ট জমি সীমিত"| জায়গির না পাওয়ার জন্য মনসবদারদের শোচনীয় অবস্থার কথা ভিনসেন্ট ও কাফি খান স্পষ্ট জানিয়েছেন|
শাসক শ্রেণীর এই সংকটকালীন অবস্থায় ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্তানিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়| এর ফলে শাসক শ্রেণীর মধ্যে দলাদলি বৃদ্ধি পাই| সব দলই চাইতেন "ওয়াজির বা মির বক্সীর মতো" গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে শাসনতন্ত্রকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে|
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র
Author- Santosh.mbahrm
Date- 26 September 2015
উদ্বৃত্ত সম্পদের স্বীয় ভাগ পাওয়ার জন্য শাসক শ্রেণীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কৃষকদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল| ইরফান হাবিব ও গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন যে, এই চাপের ফলে কৃষকরা তাদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান থেকে বঞ্চিত হতেন| জায়গিরদারদের জায়গির দাবিতে কোন স্বত্ত্ব না থাকার ফলে তাদের বদলির হার বাড়তে থাকে| স্বাভাবিকভাবেই জায়গিরদাররা নিজেদের অঞ্চলে কৃষি কাজ সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন না|
এর ফলে জায়গিরদাররা বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করে কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার কর আদায় করতেন| বার্নিয়ে, মানুচি, সাদি খান, ভিনসেন্ট স্মিথ, কাফি খান এরা প্রত্যেকেই কৃষকদের উপর জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন|
জমিদাররা(আরো পড়ুন) প্রায় তাদের জায়গির থেকে নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করতে পারতেন না বলে এই আদায় দায়িত্ব অন্য এক দলের হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতেন, তাদেরকে বলা হতো ইজারাদার| মূলত তাকেই ইজারা দেওয়া হতো যিনি সব থেকে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন|
অধ্যাপক গৌতম ভদ্র এর মতে, এইভাবে কৃষকদের উপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, তাদের কাছে বাঁচার পথ ছিল চাষবাস ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া|
বিদ্রোহ |
কৃষকদের দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায়ের শুধু ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ| অনেক ক্ষেত্রে কৃষক সমাজের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে সংগঠিত করে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জমিদাররা| কেননা জমিদাররাই প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং তাদের বিভিন্ন অধিকার ও দায়িত্ব ইজারাদাররা আত্মসাৎ করেছিল| এইভাবে বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ মুঘল সমাজের সংহতি ও শক্তির মূলে আঘাত করেছিলো|
এইভাবে মুঘল আমলে শেষ পর্বে সমাজের কৃষি ব্যবসায় এক ব্যাপকভাবে সংকটের সৃষ্টি করেছিল| জমি অনাবাদী হওয়ায় ভূমি রাজস্ব থেকে সরকারের আয় কমতে থাকে| মুঘল আমলে কৃষি সংকট এবং এর পরিণামে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে|
পরিশেষে ইরফান হাবিব বলেছেন, আওরঙ্গজেবের উত্তরসূরিদের আমলে এই সমস্যার তীব্রতা আরও বেড়ে ছিল এবং ক্রমশ তা সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল|
তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
- Shireen Moosvi, "People, Taxation and Trade in Mughal India".
সম্পর্কিত বিষয়
- মুঘল মুদ্রা ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- মুঘল চিত্রকলা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- মুঘল ভারতের ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................