বাণিজ্যিকীকরণ বলতে বোঝায়, কৃষকের স্বেচ্ছায় বাজার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া, জমির বাজার ও কৃষি পণ্যের বাজারের বিকাশ, কৃষকের স্তর বিন্যাস এবং এই সমস্ত কিছুই পরিণতি কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্কে গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা|
একথা অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে, ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকরা মূল্যের উঠা-নামা এবং বাজারের চাহিদায় সাড়া দিয়েছিল|
তবে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে বাণিজ্য জাগরণের প্রসঙ্গটি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রধান বিতর্কের একটি বিষয়| প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চাপের পড়েই বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছিল| কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণায় উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অধীনে গ্রামে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে কৃষির বাণিজ্যিকরণের কারণ খোঁজার প্রয়াস হইছে|
অধ্যাপক সুব্রত বসু মনে করেন, উপনিবেশিক ভারতের তিন ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছিল, যেমন-
একথা অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে, ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকরা মূল্যের উঠা-নামা এবং বাজারের চাহিদায় সাড়া দিয়েছিল|
কৃষক |
তবে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে বাণিজ্য জাগরণের প্রসঙ্গটি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রধান বিতর্কের একটি বিষয়| প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চাপের পড়েই বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছিল| কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণায় উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অধীনে গ্রামে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে কৃষির বাণিজ্যিকরণের কারণ খোঁজার প্রয়াস হইছে|
অধ্যাপক সুব্রত বসু মনে করেন, উপনিবেশিক ভারতের তিন ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছিল, যেমন-
- বাগিচা চাষের অর্থনীতিরকে কেন্দ্র করে plantation Agriculture
- subsistence commercialization
- dependent commercialization
বাণিজ্যিকরণ এর প্রক্রিয়া
ব্রিটিশ আমলে খাজনার অতিরিক্ত চাহিদা কৃষকদের বাজারমুখী করে তোলে| সাহিদ আমিন দেখিয়েছেন যে, বাধ্যতামূলকভাবে নগদ টাকা রাজস্ব বা খাজনা দেওয়ার জন্য কৃষকরা প্রায় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ত|
খাজনা মেটানো ও ঋণ পরিশোধের তাগিদে কৃষকের "জোরজবস্তিমূলক বাণিজ্যকরণ" এর দিকে নিয়ে যায়| খাদ্যশস্য অনুপাতে তুলা, পাট, আম প্রভৃতি অর্থকারী শস্যের ফলন বৃদ্ধি পায়, আবার খাদ্য শস্যের ফলন কমে যায়| আবহাওয়া, জমির বিশেষত্ব ও পরিবেশ অনুযায়ী ভারতের এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের অর্থকারী শস্যের চাষ শুরু হয়|
উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতের অনগ্রসর এলাকাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের চাষের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে বাণিজ্যকরণ শুরু হয়| এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল রাজস্ব ও খাজনার অতিরিক্ত চাহিদা, স্বল্প বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের অনিশ্চিয়তা, অনুর্বর জমি, অনুন্নত সেচ ব্যবস্থা প্রভৃতি|
রাজস্ব চাহিদার বৃদ্ধি চাষীদের নিল, আম, গম ইত্যাদি ফলনের বাধ্য করেছিল| এরিক স্টোকস স্বীকার করেছেন যে, "অযোধ্যায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ছিল কৃত্রিম ও জোরজবস্তি মূলক এবং রাজস্ব বৃদ্ধি ও মহাজনের চাপের পরিণতি"|
1860 এর দশকের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অভিশাপে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে তুলার আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়| এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ভারতীয় তুলার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়| সরকারি মদতে পশ্চিম ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্র অঞ্চলের তুলার ফলনের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে|
আবার রেল ও সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটে আম, তামাক, চিনা বাদাম প্রভৃতি অর্থকারী শস্যের ফলন ও রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল|
অধ্যাপক অমিত ভাদুরি বলেছেন যে, "বাংলার প্রেসিডেন্সিতে উচ্চহারে খাজনা দিতে গিয়ে ঋণের জালে এমনভাবে কৃষকদের রাখা হয়েছিল যে, তাদের কাছে ঋণের মতো খাদ্যশস্যের সঙ্গে পাটের মতো বাণিজ্যিক শস্যের কার্যত কোনো তফাৎ ছিল না"|
পাটের বীজ বন্টনের সম্পূর্ণ ব্যবসাটাই ছিল মহাজনের নিয়ন্ত্রণে| এমনকি আখ থেকে গুড় তৈরির সময় তারা মহাজনদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো| আবার পাট চাষের সম্প্রসারণ বাংলায় চিনি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল| মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গুন্টুর, মাদুরাই, কোয়েম্বাটুর প্রভৃতি অঞ্চলে তুলো চাষ খুব ভালো হতো|
1836 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহীশূরে কফি চাষ শুরু হয়, আবার গুন্টুর জেলায় শুরু হয় তামাক চাষ| বাণিজ্যিক শস্যের সঙ্গে খাদ্য শস্যের ফলনের উপরেও বণিক মহাজনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়|
জমির মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে মহাজনরা আবার মামলা করে জমি দখল নিতে থাকেন| বহিরাগত জমিদারদের উপর স্থানীয় কৃষক সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে| অবশ্য এরিক স্টোকস প্রমূখ ঐতিহাসিকরা জমির মালিকানার ব্যাপক পরিবর্তনের কথা অস্বীকার করেন|
স্টোকসের মতে, 1860-1900 খ্রিস্টাব্দ ছিল ধনী কৃষকের স্বর্ণযুগ| জর্জ গ্রিরিনের হিসাব অনুযায়ী 1901-1909 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদক জমির এলাকা বেড়েছিল মাত্র 6 শতাংশ| আর নগদ টাকায় বিক্রয়যোগ্য শস্য উৎপাদক জমির এলাকা বেড়েছিল অনেক বেশি হারে|
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাঞ্জাবের রাওয়াল পিন্ডি ইত্যাদি অঞ্চলে খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এরফলে জলের উপর কর বাড়ে| মহাজনরা কৃষকের জমি কিনতে থাকে এবং "colonisation bill" এর ফলে শিয়ালকোট, ফিরোজপুর ও লাহোরে অসন্তুষ্ট সৃষ্টি হয়| নানা আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার অধিকাংশ অরণ্য দখল করতে থাকে| এরফলেই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত সাঁওতাল, মুন্ডা ও গোদাবরী অঞ্চলে রুম্পা প্রভৃতি আদিবাসীদের বিদ্রোহ প্রশমিত হয়|
ব্রিটিশ পতাকা |
খাজনা মেটানো ও ঋণ পরিশোধের তাগিদে কৃষকের "জোরজবস্তিমূলক বাণিজ্যকরণ" এর দিকে নিয়ে যায়| খাদ্যশস্য অনুপাতে তুলা, পাট, আম প্রভৃতি অর্থকারী শস্যের ফলন বৃদ্ধি পায়, আবার খাদ্য শস্যের ফলন কমে যায়| আবহাওয়া, জমির বিশেষত্ব ও পরিবেশ অনুযায়ী ভারতের এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের অর্থকারী শস্যের চাষ শুরু হয়|
উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতের অনগ্রসর এলাকাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের চাষের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে বাণিজ্যকরণ শুরু হয়| এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল রাজস্ব ও খাজনার অতিরিক্ত চাহিদা, স্বল্প বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের অনিশ্চিয়তা, অনুর্বর জমি, অনুন্নত সেচ ব্যবস্থা প্রভৃতি|
রাজস্ব চাহিদার বৃদ্ধি চাষীদের নিল, আম, গম ইত্যাদি ফলনের বাধ্য করেছিল| এরিক স্টোকস স্বীকার করেছেন যে, "অযোধ্যায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ছিল কৃত্রিম ও জোরজবস্তি মূলক এবং রাজস্ব বৃদ্ধি ও মহাজনের চাপের পরিণতি"|
1860 এর দশকের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অভিশাপে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে তুলার আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়| এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ভারতীয় তুলার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়| সরকারি মদতে পশ্চিম ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্র অঞ্চলের তুলার ফলনের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে|
আবার রেল ও সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটে আম, তামাক, চিনা বাদাম প্রভৃতি অর্থকারী শস্যের ফলন ও রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল|
আম গাছ |
অধ্যাপক অমিত ভাদুরি বলেছেন যে, "বাংলার প্রেসিডেন্সিতে উচ্চহারে খাজনা দিতে গিয়ে ঋণের জালে এমনভাবে কৃষকদের রাখা হয়েছিল যে, তাদের কাছে ঋণের মতো খাদ্যশস্যের সঙ্গে পাটের মতো বাণিজ্যিক শস্যের কার্যত কোনো তফাৎ ছিল না"|
পাটের বীজ বন্টনের সম্পূর্ণ ব্যবসাটাই ছিল মহাজনের নিয়ন্ত্রণে| এমনকি আখ থেকে গুড় তৈরির সময় তারা মহাজনদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো| আবার পাট চাষের সম্প্রসারণ বাংলায় চিনি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল| মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গুন্টুর, মাদুরাই, কোয়েম্বাটুর প্রভৃতি অঞ্চলে তুলো চাষ খুব ভালো হতো|
1836 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহীশূরে কফি চাষ শুরু হয়, আবার গুন্টুর জেলায় শুরু হয় তামাক চাষ| বাণিজ্যিক শস্যের সঙ্গে খাদ্য শস্যের ফলনের উপরেও বণিক মহাজনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়|
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ফলাফল
কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের ফলেও জমির বাজার শুরু হয়| জমি হস্তান্তর দ্রুত গতিতে হতে থাকে| ঋণগ্রস্ত কৃষক কুল বহু জায়গায় মহাজনদের কাছে জমি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় এবং শেষে বন্ধকী জমি হারিয়ে খাজনা বা ভাগে জমি নেই|কৃষি জমি |
জমির মূল্য বৃদ্ধি ঘটলে মহাজনরা আবার মামলা করে জমি দখল নিতে থাকেন| বহিরাগত জমিদারদের উপর স্থানীয় কৃষক সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে| অবশ্য এরিক স্টোকস প্রমূখ ঐতিহাসিকরা জমির মালিকানার ব্যাপক পরিবর্তনের কথা অস্বীকার করেন|
স্টোকসের মতে, 1860-1900 খ্রিস্টাব্দ ছিল ধনী কৃষকের স্বর্ণযুগ| জর্জ গ্রিরিনের হিসাব অনুযায়ী 1901-1909 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদক জমির এলাকা বেড়েছিল মাত্র 6 শতাংশ| আর নগদ টাকায় বিক্রয়যোগ্য শস্য উৎপাদক জমির এলাকা বেড়েছিল অনেক বেশি হারে|
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাঞ্জাবের রাওয়াল পিন্ডি ইত্যাদি অঞ্চলে খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এরফলে জলের উপর কর বাড়ে| মহাজনরা কৃষকের জমি কিনতে থাকে এবং "colonisation bill" এর ফলে শিয়ালকোট, ফিরোজপুর ও লাহোরে অসন্তুষ্ট সৃষ্টি হয়| নানা আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার অধিকাংশ অরণ্য দখল করতে থাকে| এরফলেই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত সাঁওতাল, মুন্ডা ও গোদাবরী অঞ্চলে রুম্পা প্রভৃতি আদিবাসীদের বিদ্রোহ প্রশমিত হয়|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Sonali Bansal, "Modern Indian History".
সম্পর্কিত বিষয়
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................