মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে এক অভিনব কীর্তি এবং তিনি 1577 খ্রিস্টাব্দে(তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে এই সালটিকে নিয়ে) এই ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটান|
তিনি অভিজাতদের নির্দিষ্ট বেতন প্রদান করে সুকৌশলে শক্তিশালী অভিজাতদের সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীতে পরিণত করে আধুনিক আমলাতান্ত্রিক করণের দিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল| সামরিক ও বেসামরিক উভয় প্রকার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তিনি মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন করেন|
তিনি অভিজাতদের নির্দিষ্ট বেতন প্রদান করে সুকৌশলে শক্তিশালী অভিজাতদের সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীতে পরিণত করে আধুনিক আমলাতান্ত্রিক করণের দিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল| সামরিক ও বেসামরিক উভয় প্রকার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তিনি মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন করেন|
মনসবদারি ব্যবস্থার গুণ
মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের ফলে রাজকোষে প্রচুর টাকা আসে এবং সৈন্য বিভাগে দক্ষতা ও সংহতি সাধিত হয়| দাগ ও হুলিয়া প্রচলিত হওয়ায় কারচুপি করার পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যায় এবং মনসবদারদের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, ফলে ব্যক্তিগতভাবে সম্পদ জমা করার প্রবণতা অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যায়|
আকবরের সাফল্য, ব্যক্তিত্ব এবং মহানুভবতা, অভিজাতদের অনুরাগ এবং আনুগত্য অর্জন করেছিল এবং একটি বিশেষ ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছিল| এই প্রথার মাধ্যমে আকবর অভিজাত গোষ্ঠীকে একটি সুসামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে অভিজাত শ্রেণীকে একটি দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্য উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্রে পরিণত করেন|
বিশেষ জাতি, ধর্ম ও দেশের গোষ্ঠী সমন্বিত অভিজাত সমাজকে এমনভাবে সংগঠিত করেন, যার ফলে আকবরকে আর কোন বিশেষ শ্রেণীর উপর নির্ভর করতে হতো না|
আকবরের রাজত্বকালের প্রথম দিকে পুরাতন অভিজাতদের প্রতি তার বিশ্বাস না থাকার ফলে রাজপুত মৈত্রীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন| মনসবদারি প্রথার মাধ্যমে তিনি এই পরিস্থিতির অবসান ঘটান|
তবে ঐতিহাসিক আরভিন এর মতে, এই প্রথা মুঘল বাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছিল| কিন্তু এই অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ঐতিহাসিক শিরিন মুসভি তাঁর গবেষণায় দেখান যে, আকবরের মতো ব্যক্তির প্রভাবে এই ব্যবস্থা মুঘল সাম্রাজ্যের, মুঘল অভিজাতদের এবং সামরিক কার্যাবলীতে এক ধরনের উচ্চ স্তরের ঐক্য ও শৃঙ্খলা এনেছিলেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে এর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ|
মনসবদারি ব্যবস্থার ত্রুটি
মনসবদারি প্রথার ত্রুটি এবং দুর্বলতাগুলি ছিল কিছুটা সহজাত এবং কিছুটা আরোপিত| মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য| এই প্রথার প্রধান ত্রুটিগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-
- বদাউনি(আরো পড়ুন) লিখেছেন, মুঘল মনসবদাররা রাস্তা থেকে লোক ধরে নিয়ে এসে তারা সরকারকে সৈন্য হিসাবে দেখাতো| উন্নতমানের ঘোড়াগুলি তারা বিক্রি করে নিম্নমানের ঘোড়া কিনতো|
- মনসবদাররা তাদের সৈন্যদের বেতন দেওয়ার অধিকারী ছিলেন| এই বেতনের বেশিরভাগ টাকা তারা নিজেরাই ভোগ করত| তাছাড়া তাদের জন্য জায়গির নির্দিষ্ট রাখা হতো, সেখান থেকে তারা 4 থেকে 9 মাসের বেতন পেতেন|
- ঐতিহাসিক আরভিন লিখেছেন, মনসবদাররা ছিল একটি চলমান বাজার| পরবর্তীকালে এই মুঘল বাহিনী তাদের গতি হারিয়ে ফেলেছিল|
- মুঘল বাহিনীতে মনসবদাররা উন্নতমানের গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি| অথচ এই প্রযুক্তি ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছে ছিল| তাছাড়া মুঘল বাহিনী কোন দিন জাতীয় বাহিনী হয়ে উঠতে পারিনি| সাধারণ স্বার্থ বা দেশ প্রেম না থাকার জন্য এই বাহিনী ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর পড়েছিল|
- তাছাড়া অধিকাংশ মনসবদাররা সুযোগ সন্ধানী ছিল| এই কারণে মুঘল বাহিনী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সংগঠনের অভাবে ক্রমশ অবনতি দিকে পা বাড়িয়ে ছিল|
এই প্রথার ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মনসবদারী ব্যবস্থা মুঘল আমলে চলমান সামরিক সংগঠনের ব্যবস্থার উপর সুনির্দিষ্ট উন্নতি ছিল|
তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
সম্পর্কিত বিষয়
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মনসবদারি ব্যবস্থা এবং পরবর্তীকালে জায়গির সংকট (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................