ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং 1905 খ্রিস্টাব্দে এই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সামগ্রিক তত্ত্বের দাবী করতে পারি কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেও তৎকালীন মুসলমান সমাজের এক বিরাট অংশ এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে ইংরেজদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে ছিল। তবে এই বিষয়টি বিতর্কিত হলেও নিঃসন্দেহে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে তার সামগ্রিক তত্ত্বের প্রশ্নে এই বিষয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
হিন্দু-মুসলিম |
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকা
এই কথা ঠিক যে, ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করে মুসলমানদের কিছুটা সন্তুষ্ট করেছিল। তবে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। এই সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হলেও, এই আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানত হিন্দুরা। অবশ্য ব্রিটিশ প্ররোচনা ও অপপ্রচারের সত্ত্বেও বেশকিছু মুসলমান বঙ্গ বিভাজনের বিরুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন।
এই বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান সমাজের এক বিরাট অংশ মুখ ফিরিয়ে থাকলেও যারা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, রিয়াকৎ হোসেন প্রমূখ ব্যক্তিরা। সমকালীন সংবাদ পত্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ, বরিশাল ইত্যাদি স্থানে মসজিদে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বেশকিছু মুসলমান যুবক ও ছাত্র গ্রামগঞ্জে স্বদেশী স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। 1905 খ্রিস্টাব্দে 23 শে সেপ্টেম্বর কলকাতায় মহা মিছিলে বহু মুসলমান অংশগ্রহণ করে, আবার রাখি বন্ধন উৎসবে বহু মুসলমান অংশ নিয়ে হিন্দুদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
রাখি বন্ধন উৎসব |
এছাড়া কিছু মুসলমান জমিদার যেমন- আব্দুল সোবহান চৌধুরী, ফরিদপুরের আলী মুহ্যমান প্রমুখেরা স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। মজিবুর রহমান "দ্য মুসলমান" নামক ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশ করে ইংরেজদের বঙ্গভঙ্গের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। এছাড়া "সুলতান" নামক আরেকটি পত্রিকায় বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলনকে আরো উৎসাহিত করা হয়।
বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া
এই বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এটি কিন্তু সম্পূর্ণ চিত্র ছিল না। ব্রিটিশ প্রচার দ্বারা মুসলমান সমাজের একটি বিরাট অংশ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর এবং বেশকিছু মৌলভী প্রচার চালায় যে, ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন প্রদেশ গড়ে উঠলে তা মুসলমানদের স্বার্থের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে, এই সূত্রে মুসলমানরা মুসলিম লীগ গঠনের চেষ্টাকে বাস্তবায়িত করে তুলেছিল।
এই বিরোধী আন্দোলনে সামগ্রিক কালে 1906 থেকে 1908 খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরগঞ্জ, কুমিল্লা, জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে হিন্দুদের কোন দোষ ছিল না তা নয়। হিন্দু জাগরণ ও প্রাচীন হিন্দু সভ্যতায় মুসলমানদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে।
উপসংহার
অধ্যাপক সুমিত সরকার এই বিষয়ে একমত যে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।
বঙ্গভঙ্গ ও তার বিরোধী আন্দোলন, মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি, সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে এই কথা বলা যায় যে, মুসলমানদের মূল স্রোত বঙ্গভঙ্গের ছিল। আব্দুল রসূল, আব্দুল হালিম প্রমুখরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলেও, তা কখনোই মুসলমান সমাজের ভাবনার সার্বিক প্রকাশ নয় এবং এমনকি অনেকেই বঙ্গভঙ্গের ক্ষেত্রে মুসলমান দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পরবর্তীকালে দেশবিভাগের অস্পষ্ট উৎস খুঁজে পেয়েছেন।
.......................................
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Dennis Kincaid, "British Social Life In India, 1608–1937".
সম্পর্কিত বিষয়
- 1946 সালের নৌ বিদ্রোহ (আরো পড়ুন)
- সম্পদের বহির্গমন তত্ত্ব এবং এটি কিভাবে বাংলার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল (আরো পড়ুন)
- ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।