আধুনিক ভারতের নির্মাতা হিসেবে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত| তাঁকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বা আধুনিক ভারতের জনক প্রভৃতি নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে|
অনেকের মতে তিনি ভারতের ইরাসমাস ছিলেন| ডঃ বিপান চন্দ্র রামমোহনকে নবজাগরণের কেন্দ্র বিন্দু বলে অভিহিত করেছেন| তবে এটা ঠিক যে, আজ আমাদের সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সমাজনীতি ও অরাষ্ট্রনীতি যাকে আমরা আধুনিক বলি না কেন রামমোহন হলেন তারই অগ্রদূত|
রামমোহন রায় (22 মে, 1772 – অক্টোবর 30, 1833) Source- wikipedia (check here) Year of publication- 1907 Author- Sastri, Sibnath Modified- colour and background |
ভিডিও
রামমোহন রায়ের ধর্মীয় সংস্কার
ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্তত উদার ও সহানুভূতিশীল| যেকোন ধর্মের গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী| তিনি হিন্দু সমাজে প্রচলিত মূর্তি পূজা, জাতিভেদ প্রথা ও অর্থহীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিরোধিতা করেন|
এক ঈশ্বরবাদের সমর্থক হয়ে তিনি 1829 খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন| এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের সংস্কার ও এক ঈশ্বরবাদের প্রচার করা| ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, খ্রিস্টান মিশনারিদের ধারালো আক্রমণ থেকে শাশ্বত হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করা এবং বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠা করা| তাই ভারতীয় হিন্দু ভাবনায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ফরাসি ভাষায় তুহাফত উল মহাদ্দিন বা এক ঈশ্বরবাদের প্রতি রচনা করেন|
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার
সংস্কার মুক্ত যুক্তিবাদী রামমোহন হিন্দু সমাজের প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন|
এই মহান নির্মাতা এক্ষেত্রে রামমোহনের সবচেয়ে বড় অবদান হলো সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন(আরো পড়ুন)| প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক 1829 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা রদ করেন|
অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন যে, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে চেতনা সৃষ্টির জন্য রামমোহন তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, যথা-
Title-সতীদাহ প্রথা Author-Frederic Shoberl Source - wikipedia (check here) licence- creative commons Modified- colour and background |
এই মহান নির্মাতা এক্ষেত্রে রামমোহনের সবচেয়ে বড় অবদান হলো সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন(আরো পড়ুন)| প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক 1829 খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা রদ করেন|
অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন যে, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে চেতনা সৃষ্টির জন্য রামমোহন তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, যথা-
- বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে সতীদাহ প্রথাকে অশাস্ত্রতে পরিণত করা|
- সংবাদ পত্রের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলা|
- স্বামীর চিতায় জীবন উৎসর্গের ইচ্ছুক নারীদের প্রতি নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা|
আধুনিক শিক্ষার প্রসারে রামমোহন
আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁকে প্রতীক বলা চলে| হিন্দু কলেজ স্থাপনের ব্যাপারে তিনি ডেভিড হেয়ারকে নানাভাবে সাহায্য করেন| তিনি নিজে কলকাতায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর বেদান্ত কলেজের মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন|সাংবাদিকতার জনক হিসেবে রামমোহন
ডঃ বিপান চন্দ্র মতে বলা যায় যে, রামমোহন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও একজন অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়েছিল| তাঁর প্রকাশিত পত্রিকাগুলির মধ্যে ছিল বাংলা ভাষায় "সংবাদ কৌমুদী" এবং ফরাসিতে "মিরাৎ-উল-আকবর"| এছাড়াও তিনি প্রেস অর্ডিনেশন জারি করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় কাছে প্রতিবাদ পত্র পাঠান|রামমোহনের রাজনৈতিক চিন্তাধারা
জাতীয়তাবাদ প্রসারে আন্দোলনে রামমোহন
রামমোহন ছিলেন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের প্রভু| আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ(আরও পড়ুন) ও ফরাসি বিপ্লব তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল| প্রতিটি দেশে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদে তিনি বড় সমর্থক ছিলেন|বিপান চন্দ্রের মতে, "আন্ত-জাতীয়তাবাদের এমন সুন্দর সংমিশ্রণ রামমোহন ছাড়া আর কারোর মধ্যে দেখা যায়নি"|
রামমোহনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা
তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও রায়তওয়ারি ব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন|
রামমোহনের সীমাবদ্ধতা
আধুনিক ভারতের নির্মাতা হিসেবে রামমোহনের যুগান্তকারী অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেও বিভিন্ন পন্ডিত ও সমালোচকরা তাঁর সীমাবদ্ধতার সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না|মার্কিন ঐতিহাসিক ডেভিড কফ রামমোহনকে কখনোই আধুনিক ভারতের জনক বলতে রাজি নন| তাঁর বিরুদ্ধে ডঃ মজুমদার ও ডঃ ডেভিড কফ যুক্তি দেখিয়েছেন যে,
- হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কারের কথা বললেও জাতিভেদ প্রথা, বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ বিরুদ্ধে রামমোহন সেভাবে রুখে দাঁড়াননি|
- হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে গিয়ে যুক্তি নয়, তিনি ধর্ম শাস্ত্রগুলির উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন|
- সংস্কৃত ভাষা ও দেশীয় শিক্ষার প্রতি তিনি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন|
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কোম্পানির বাণিজ্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি বিরোধিতা করলেও নীলকর চাষীদের অত্যাচার এবং ভারতবর্ষের অবশিল্পায়নের প্রতি মুখ খুলেননি|
উপরোক্ত আলোচনা সত্ত্বেও রামমোহনকে নিঃসন্দেহে নব ভারতের অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়|
অন্যদিকে ঐতিহাসিক সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন যে, রামমোহন ছিলেন সত্যিকারের একজন সমাজ সংস্কারক, উগ্র বিপ্লববাদী নয়|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারতের ইতিহাস"
- Harihara Dasa, "The Indian renaissance and Raja Rammohan Roy".
- Sonali Bansal, "Modern Indian History".
সম্পর্কিত বিষয়
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................