স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে যেসব জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির জটিল সমস্যা| স্বাধীনতার প্রাক্কালে এইসব দেশীয় রাজ্যগুলির সংখ্যা ছিল 60 |এই রাজ্যগুলির ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল এবং তাদের সমষ্ঠিগত আয়তন ছিল সমগ্র ভারত ভূখণ্ডের শতকরা 48 ভাগ|
দেশীয় রাজ্যগুলির লোক সংখ্যা ছিল 7 কোটি, আর দেশভাগের পর ভারতের লোক সংখ্যা ছিল 39 কোটি|স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এই বিপুল সংখ্যক রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ কি হবে, তা নিয়ে জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি হয়|
বর্তমানে ভারতের মানচিত্র |
1946 খ্রিস্টাব্দে 16 ই মে ক্যাবিনেট মিশন মিশন ঘোষণা করে যে-
- ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় রাজ্যগুলির উপর থেকে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে|
- স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন হবে এবং ব্রিটিশ বৈদেশিক নীতি, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ইউনিয়ন সরকারের কর্তৃত্ব থাকবে|
- এই বিষয়গুলি ব্যতীত অসাম্য সকল বিষয়ের উপর দেশীয় রাজন্যবর্গের অধিকার থাকবে|
1947 খ্রিস্টাব্দে 14 ই জুলাই "ভারতীয় স্বাধীনতা আইন"-এ দেশীয় রাজ্যগুলিকে হয় নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখা, অথবা ভারত ও পাকিস্তান- যে কোন রাষ্ট্রে যোগদানের কথা বলা হয়| এই বিলে রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি|
এটলী আরও বলেন যে, দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার ফলে এই রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য, সুতরাং এই রাজ্যগুলির উচিত ভারত বা পাকিস্তান কোন একটি রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া|
জহরলাল নেহেরু বলেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোন স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে না| গান্ধীজীও সরাসরি জানিয়ে দেন যে, কোন দেশীয় রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তা স্বাধীন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে বিবেচিত হবে| দেশীয় রাজ্যগুলিকে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করার পশ্চাতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল-
এটলী আরও বলেন যে, দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার ফলে এই রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য, সুতরাং এই রাজ্যগুলির উচিত ভারত বা পাকিস্তান কোন একটি রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া|
গান্ধীজী |
গান্ধীজী |
জহরলাল নেহেরু বলেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোন স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে না| গান্ধীজীও সরাসরি জানিয়ে দেন যে, কোন দেশীয় রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তা স্বাধীন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে বিবেচিত হবে| দেশীয় রাজ্যগুলিকে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করার পশ্চাতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল-
- ভারতীয় নেতৃমন্ডলী অখন্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন| সুতরাং ভারত ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কোন বিচ্ছিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতে তারা রাজি ছিল না|
- দেশীয় রাজ্যগুলির অধিকাংশই মধ্যযুগীয় ভাবধারা, স্বৈরাচারী শাসন ও কুসংস্কারের আবর্তে নিমজ্জিত ছিল|
- বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলিতেও তখন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবিতে প্রবল প্রজা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল|
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অবদান
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সংক্রান্ত সমাধানে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান স্বাধীন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল| "লৌহ মানব" নামে খ্যাত সর্দার প্যাটেলের পরামর্শক্রমে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্ত সংক্রান্ত বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত হন বিশিষ্ট আমলা ভি. পি. মেনন|
জওহরলাল নেহেরু |
লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রথম থেকেই দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির সমর্থক ছিলেন| এই পরিস্থিতি চমৎকারভাবে সামাল দেবার কর্তৃত্ব দেখান সর্দার প্যাটেল| দেশীয় রাজ্যগুলির উপর প্রবল কূটনৈতিক চাপ, সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি, জনগণকে রাজন্য বিরোধী ও ভারতমুখী আন্দোলনের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি রাজন্যবর্গের মগজ ধোলাই এর কর্মসূচি চালিয়ে যান|
ঐক্য ও সভ্যতার আদর্শ পালন করে সর্দার প্যাটেল দেশীয় রাজন্যবর্গকে বৃহত্তম ও শক্তিশালী ভারত রাষ্ট্র গঠনের মহাযজ্ঞে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান| সর্দার প্যাটেল রাজ্য মন্ত্রী হিসাবে ভারত ইউনিয়নের সন্নিহিত সমস্ত দেশীয় রাজ্যের রাজন্যবর্গকে বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে ভারতের সাথে যুক্ত হবার আবেদন জানান|
বল্লভভাই প্যাটেল |
ভারত স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিনি সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ দেশীয় রাজা বিশাল ভাতা, রাজকীয় খেতাব ও অন্যান্য সুবিধার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে "Instrument of Accession" নামক দলিল স্বাক্ষর করে ভারতের সাথে যুক্ত হন|
তিনটি রাজ্য- জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর প্রথম পর্যায়ে ভারতের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়| অবশ্য কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই রাজ্যগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে| এই অসাধ্য সাধনের মুখ্য রূপকার অবশ্যই ছিলেন সর্দার প্যাটেল|
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের সাথে সংযুক্তিকরণের কাজে ভারত সরকার কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করে-
- সন্নিহিত প্রদেশগুলির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি| যেমন- ওড়িশা ও মধ্য প্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি, বোম্বাই সঙ্গে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটের রাজ্যগুলি, কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, মাদ্রাজের রাজ্যগুলিকে মাদ্রাজের সঙ্গে প্রভৃতির রাজ্য সংযুক্তির কথা বলা হয়|
- কয়েকটি রাজ্যকে সংযুক্তি করে এক একটি বৃহৎ যুক্ত রাজ্য গঠন করা হয়| উদাহরণ হিসাবে রাজস্থানের যুক্তরাজ্য, পাঞ্জাবের যুক্তরাজ্য, বিন্ধ্য প্রদেশের যুক্তরাজ্য প্রভৃতির কথা বলা হয়|
- কয়েকটি রাজ্যকে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে রাখা হয়| যেমন- হিমাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা, বিলাসপুর, মনিপুর, ভূপাল ইত্যাদি|
প্যাটেলের উদ্যোগে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতের সাথে যোগ দিলেও তিনটি রাজ্য- জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল|
প্যাটেল এই তিনটি রাজ্য সম্পর্কে দাবার বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার করে বলেছেন, "হায়দ্রাবাদ হলো রাজা, জুনাগর বোড়ে এবং কাশ্মীর হলো রানি"| তবে প্যাটেল কাশ্মীর সম্পর্কে ততটা আগ্রহী ছিলেন না, জুনাগর ও হায়দ্রাবাদ পেলেই তাঁর চলত| কিন্তু জহরলাল নেহেরু কাশ্মীর পেতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন|
প্যাটেল এই তিনটি রাজ্য সম্পর্কে দাবার বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার করে বলেছেন, "হায়দ্রাবাদ হলো রাজা, জুনাগর বোড়ে এবং কাশ্মীর হলো রানি"| তবে প্যাটেল কাশ্মীর সম্পর্কে ততটা আগ্রহী ছিলেন না, জুনাগর ও হায়দ্রাবাদ পেলেই তাঁর চলত| কিন্তু জহরলাল নেহেরু কাশ্মীর পেতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন|
অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, তাঁর(প্যাটেল) আপাতত রাজা এবং বোড়ে পেলেই চলবে| মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর পাকিস্থানের সাথে যোগ দিলে তাঁর আপত্তি ছিল না|
মাউন্টব্যাটেনও চেয়েছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের সাথে যোগ দিক, কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে নেহেরু আবেগের বন্যা সব আপত্তি ভাসিয়ে দিয়েছিল| শেষ পর্যন্ত প্যাটেল ও জওহরলালের বলিষ্ঠ নীতির ফলে জুনাগর ও হায়দাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও এক জটিল রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় হিসাবে এখনোও তার(কাশ্মীর) নাম উচ্চারিত হয়|
মাউন্টব্যাটেনও চেয়েছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের সাথে যোগ দিক, কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে নেহেরু আবেগের বন্যা সব আপত্তি ভাসিয়ে দিয়েছিল| শেষ পর্যন্ত প্যাটেল ও জওহরলালের বলিষ্ঠ নীতির ফলে জুনাগর ও হায়দাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও এক জটিল রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় হিসাবে এখনোও তার(কাশ্মীর) নাম উচ্চারিত হয়|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Ishita Banerjee-Dube, "A History of Modern India".
সম্পর্কিত বিষয়
- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি (আরো পড়ুন)
- ক্রিপস মিশন ব্যর্থতার কারণ (আরো পড়ুন)
- সম্পদের বহির্গমন তত্ত্ব এবং এটি কিভাবে বাংলার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল (আরো পড়ুন)
- ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................