ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ভারতের বহির্বাণিজ্যের একটি বড় দিক হলো ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য। এই বাণিজ্য গুজরাটের মুসলিম বণিকরা প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জাহাজের মালিকানা ছিল তাদের হাতে। মালাক্কা ছিল এশিয়ার বাণিজ্যের একটি বড় কেন্দ্র। বাংলা ও করমন্ডলের হিন্দু বণিকরা এখানে তাদের পণ্য নিয়ে হাজির হতেন, তবে জাহাজের মালিক ছিলেন মুসলিম বণিকরা।
ভারতীয়রা মালাক্কা থেকে কিনতেন জায়ফল, চীনের রেশম, বাসনপত্র ইত্যাদি। চীনারা আবার এখান থেকে প্রচুর গোলমরিচ কিনত, যার প্রধান অংশ আসত মালাবার থেকে। ভারতীয় পণ্য আফিম, গন্ধ দ্রব্য, চন্দন কাঠ ও মূল্যবান পাথর চীনারা কিনতেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় বণিকদের উপস্থিতি ছিল বেশ জোরালো।
পশ্চিম দিকে ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্য ছিল লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। লোহিত সাগর হয়ে ভারতীয় পণ্য আলেকজান্দ্রিয়া ও কায়রো পৌঁছে যেত। আবার পারস্য উপসাগর হয়ে ভারতীয় পণ্য চলে যেত বাগদাদে। আরব ও ইয়েসেন শহর এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে ভারতীয়দের উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন যে, ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য ছিল বহু জাতি। হিন্দু বানিয়া, মুসলমান, ইহুদি সকলেই এই বাণিজ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ভারত থেকে রপ্তানি করা হতো চাল, ডাল, তেল, হলুদ, চিনি, কাঁচা রেশম প্রভৃতি। ভারত বিদেশ থেকে আমদানি করত সোনা, রুপা, পূর্ব আফ্রিকার ফল, ঔষধ প্রভৃতি। এটা ঠিক যে, সপ্তদশ শতাব্দীর ও অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য প্রধানত ভারতীয় জাহাজী বণিকদের হাতে ছিল। ইউরোপীয়রা এর মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। ভারতের জাহাজের মালিকরা তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের নাবিক হিসাবে নিযুক্ত করতেন এবং জাহাজ পরিচালনায় তাদের খুব সুবিধা হত।
ভারতীয় জাহাজের মালিকরা ও বণিকরা প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। হিন্দু বণিকরা প্রধানত দেশের ভিতর থেকে মাল চালান দিতেন। ভারতীয় বণিকদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
- প্রথমত, ধনী বণিক- যিনি নিজের পণ্য নিয়ে বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতে।
- দ্বিতীয়ত, ধনী বণিকদের প্রতিনিধিরা বিদেশে গিয়ে বাণিজ্য করতেন।
- তৃতীয়ত, ছোট মাঝারি বণিক যারা অল্প পণ্য নিয়ে বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াতেন।
রেশম কাপড় |
ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত বণিকদের অনেকে বন্দরের বণিক ও দালালের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ করতেন। এছাড়া বন্দরের টাকশালের সোনা ও রুপার মুদ্রনের ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং ভারত মহাসাগরের সঙ্গে তথা বাণিজ্যের সঙ্গে বহু শ্রেণীর মানুষ নিযুক্ত ছিল।
শুধুমাত্র মূলধন থাকলে ভারতীয় মহাসাগরের বাণিজ্য করা যেত না, স্থানীয় সাহায্যের প্রয়োজন হতো। তবে সরকার বণিকদের সহচরাচর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। ভারত মহাসাগর বানিজ্য অবশ্য ওঠা-নামা ছিল। হজের সময় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল এবং লোহিত সাগরে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকত। রাজনৈতিক অশান্তি শুরু হলে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা কমে যেত। ভারত মহাসাগরের পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজ বাণিজ্যের পরিমাণ তেমন বেশি ছিল না। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যের প্রাধান্য ছিল ভারতীয়দেরই।
সব দিক থেকে বিবেচনা করলে সপ্তদশ শতাব্দীর মুঘল ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যের "স্বর্ণ যুগ" বলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু এই যুগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মুসলিমদের পতন, পারস্যের অবক্ষয়, ইয়েনেমের গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি কারণে ভারতীয় মহাসাগরের বাণিজ্য বেশি ক্ষতি হয়েছিল। যেখানে 1707 খ্রিস্টাব্দে জাহাজের সংখ্যা ছিল 112 টি, সেখানে 1750 খ্রিস্টাব্দে হয়ে দাঁড়ায় মাত্র 20 টি। মাদ্রাজ পূর্ব উপকূলের বড় বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ইংরেজরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছিল।
👉তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"।
- Shireen Moosvi, "People, Taxation and Trade in Mughal India".
👉সম্পর্কিত বিষয়
- মুঘল মুদ্রা ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল চিত্রকলা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল যুগের বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এর গুরুত্ব (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল ভারতের ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।📖
......................................................