ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে উনিশ শতকের বাংলায় সংস্কৃতি ও চিন্তায় যে সুদূর পরিবর্তন এসেছিল, তাকে সমসাময়িক পন্ডিত ও তার পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা "বাংলার নবজাগরণ" বা "Bengal Renaissance" বলে আখ্যায়িত করেছেন|
আবার এই নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের প্রকৃত চরিত্র নিয়ে, তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে এবং এটি আদৌও নবজাগরণ ছিল কিনা, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালের পন্ডিত ও ঐতিহাসিকের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই|
আবার এই নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের প্রকৃত চরিত্র নিয়ে, তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে এবং এটি আদৌও নবজাগরণ ছিল কিনা, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালের পন্ডিত ও ঐতিহাসিকের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই|
উনিশ শতকের পেক্ষাপটে রেনেসাঁস কথাটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলেন, তা বলা খুব কঠিন| বিপান চন্দ্র ইতালি ও বাংলার রেনেসাঁ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এবং রামমোহন রায়কে চিহ্নিত করেছিলেন তার প্রতিকৃত হিসাবে|
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ইংরেজদের দেওয়া সব থেকে বড় উপহার আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ| আবার অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বাংলার নবজাগরণকে দেখে ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে| অন্যদিকে বিনয় ঘোষ মনে করেন, বাংলার নবজাগরণ একটি "অতিকথা মাত্র"| অধ্যাপক বরুণ দে, অশোক সেন, সুমিত সরকার মনে করেন, উনিশ শতকের বাংলায় যা হয়েছিল তা আধুনিকরণ রেনেসাঁস নয়|
অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট ও প্রকৃতির সঙ্গে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের ইতালি বা ইউরোপীয় রেনেসাঁর তুলনা অর্থহীন| ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উত্তোলন| এর ফলে সামাজিক কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল| ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে বণিক শ্রেণী বহন করে নিয়ে এসেছিল এক নতুন জীবনের যাত্রা| হস্তশিল্প থেকে শ্রম শিল্পের উত্তোলনের উৎপাদন ব্যবস্থায় এসেছিল ব্যাপক পরিবর্তন| বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও যুক্তিবাদী দর্শনের উন্মেষের চিন্তা জগতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দিয়েছিল| ফলে ভেঙে পড়ে কুসংস্কারের দুর্গ এবং ধ্বংসের পথে তলিয়ে যায় যাজক সম্প্রদায়|
কিন্তু বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল পুরোপুরি আলাদা| এখানে ধনী ভূস্বামী শ্রেণী ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় নবজাগরণের সূত্রপাত করেছিল| এদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়|
অধ্যাপক সুশোভন সরকারের মতে, ইউরোপের মতো বাংলার নবজাগরণের মতাদর্শগত ভিত্তি ছিল উদারপন্থী, যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানবতাবাদ| কিন্তু এই বক্তব্য পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না| সুমিত সরকার বলেছেন, তথাকথিত নবজাগরণের মধ্যে প্রথম থেকে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব এবং মুসলিম বিদ্বেষ থেকে গিয়েছিল|
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সব থেকে বড় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আধুনিকতার আগমন| উনিশ শতকের আধুনিকতা ছিল ভারতবর্ষের পরাধীনতার সমর্থনের সঙ্গে থেকে যুক্ত| ব্রিটিশ শাসনের উপযোগিতা সম্পর্কে নবজাগরণের নেতাদের এমন এক মনোভাব ছিল যে, তারা তা অতিক্রম করে এর নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে দেখতে পাইনি|
রামমোহন ভারতে ব্রিটিশ পুঁজির অনুপ্রবেশ এমনকি নীলকর সাহেবদের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন| নবজাগরণের মধ্যবিত্ত ও ভদ্র লোকের সাথে গ্রাম ও শহরের অগণিত দরিদ্র মানুষের কোনো সম্পর্কই ছিল না| এরা কোন ব্যাপারে আন্দোলন বা মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেনি| তাছাড়া মুসলিম সম্প্রদায় উনিশ শতকের নবজাগরণের মূলস্রোতের বাইরে ছিল বলে এই নবজাগরণ খন্ডিত বা অসম্পূর্ণ রূপ নিয়েছিল|
তবে কিছু সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বাংলার নবজাগরণের বেশ কিছু গঠনমূলক দিক ছিল| তা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না| নবজাগরণের সব থেকে বড় অবদান ছিল সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম| ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা বিস্তারে যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য| পাশ্চাত্য শিক্ষা ও আদর্শ এই যুগের মনীষীদের আকৃষ্ট না করলেও তারা সব সময় পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করেনি|
তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারতের ইতিহাস"
- Harihara Dasa, "The Indian renaissance and Raja Rammohan Roy".
- Sonali Bansal, "Modern Indian History".
সম্পর্কিত বিষয়
- ঊনবিংশ শতকে নারী সংক্রান্ত সমস্যা (আরো পড়ুন)
- রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা এবং অবদান (আরো পড়ুন)
- সাহিত্য ও শিল্পের উপর রেনেসাঁ এর প্রভাব (আরো পড়ুন)
- নবজাগরণ বা রেনেসাঁ কাকে বলে এবং ইউরোপীয় সমাজের উপর এর প্রভাব .(আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................