স্বদেশী আন্দোলন

বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নারী, ছাত্র, শহর ও গ্রামের জনগনের একটা বড় অংশ এই প্রথম সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন রাজনীতি সঙ্গে| ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের প্রায় সমস্ত বড় বড় রাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব ঘটেছিল পরবর্তী পাঁচ বছরে|

রক্ষণশীল নরমপন্থী থেকে রাজনৈতিক চরমপন্থী পর্যন্ত, সন্ত্রাসবাদ থেকে জাগমান সমাজতন্ত্র পর্যন্ত, আবেদন-নিবেদন ও জনসভার বক্তৃতা থেকে পরোক্ষ প্রতিরোধ ও বয়কট পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক ধারার উত্তম ছিল এই আন্দোলন|

স্বদেশী-আন্দোলন
ভারতের মানচিত্র


বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন

স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের গর্ভে| 1905 খ্রিস্টাব্দের লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ| প্রথম দুই মাসের শুরুতেই পশ্চিম বাংলাতে অনুষ্ঠিত হয় 500 টি প্রতিবাদ সভা| সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, কৃষ্ণ কুমার মিত্র ও অন্যান্য নেতারা "বেঙ্গলি", "সঞ্জীবনী" প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালাতে থাকেন| 1903 খ্রিস্টাব্দে থেকে 1905 খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত স্মারক লিপি, আবেদন-নিবেদন, বক্তৃতা, জনসভা ও সংবাদপত্রের প্রচারের মতো নরমপন্থী কৌশলেই বিস্তার করেছিল|

স্বদেশী-আন্দোলন
প্রতিবাদ


কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও 1905 খ্রিস্টাব্দের 19 শে জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়| জাতীয়তাবাদীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তাদের নরমপন্থী কৌশল আর ঘটছে না| সরকারি ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় বিদেশী পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়|

1905 খ্রিস্টাব্দের 5 ই আগস্ট কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত সভায় পাশ হল বিখ্যাত বয়কট প্রস্তাব| বঙ্গভঙ্গের দিনে 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 ই অক্টোবর সারা বাংলা জুড়ে লোকসভা পালন করা হয়| হরতাল ডাকা হয় কলকাতায়, যেখানে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও আনন্দমোহন বসু প্রায় 75 হাজার লোকের জনসভায় ভাষণ দিলেন| স্পষ্ট হয়ে গেল লক্ষ্য ও সামাজিক ভিত্তি উভয় দিক থেকেই আন্দোলনের চরিত্র দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করেছিল|



স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন

স্বদেশী আন্দোলন ও বিদেশী পণ্য বর্জনের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে| 1905 সালে কংগ্রেসের "বেনারস" অধিবেশনে বাংলার স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল| বালগঙ্গাধর তিলক ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদীরা অবশ্য এই আন্দোলনের সর্বভারতীয় রূপ দেওয়ার এবং পূর্ণ রাজনৈতিক গণসংগ্রাম সংঘটিত করার পক্ষে ছিলেন|


স্বদেশী আন্দোলনের ফলাফল

অধ্যাপক বিপান চন্দ্র বলেছেন, স্বদেশী আন্দোলনের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল চরমপন্থীরা| তারা চেয়েছিলেন বয়কট আন্দোলনকে অসহযোগ ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের সম্প্রসারিত করে রাজনীতি স্বাধীনতা অর্জন করতে| সম্প্রসারিত বয়কটের কৌশলে বিদেশী পন্য বর্জন ছাড়াও সরকারি স্কুল, কলেজ, আদালত, খেতাব ও সরকারি চাকরি বর্জন এমনকি ধর্মঘট সংঘটিত করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত হয়|

জন সংযোগের কাজে চরমপন্থী নেতৃত্ব দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন-
  1. প্রথমটি হলো, সমিতিগুলির মধ্যে বরিশালের "স্বদেশ বান্ধব সমিতি", ফরিদপুরে "ব্রতী", ঢাকার "অনুশীলন সমিতি" প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য| এইসব সমিতি স্বদেশী আন্দোলনের ভাবধারা গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিত বক্তৃতা ও স্বদেশী গানের মাধ্যমে| অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, সমিতিগুলিতে ছাত্র সমাজের ভূমিকা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না| বড় ভূস্বামী শ্রেণীর লোক বেশি করে এই ধরনের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন| স্বদেশী নেতারা ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ক্লাইভ জুট মিল প্রভৃতির মত বিদেশি সংস্থায় শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করেছিল|
  2. দ্বিতীয়টি হলো, সনাতন হিন্দু ধর্মের আবেদন, প্রাচীন ভারতের গৌরবজ্জল হিন্দু ধর্ম ও সভ্যতার আদর্শ তুলে ধরা হয়| শিবাজী ও রাজপুত জাতির বিরুদ্ধে সংগ্রামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়| 
স্বদেশী আন্দোলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্বনির্ভরতা বা আত্মশক্তি উপর গুরুত্ব আরোপ| নিজের কাজ নিজে করা ও গ্রাম স্তরে গঠনমূলক কাজ কর্মকে দেখা হতো গ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটানো ও গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছানোর হাতিয়ার হিসাবে| 

স্বদেশী-আন্দোলন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


স্বনির্ভরতার আরেকটি স্তম্ভ ছিল স্বদেশী বা জাতীয় শিক্ষা কর্মসূচি| কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত হয় "বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ"| গোটা দেশজুড়ে স্থাপিত হয় বহু জাতীয় বিদ্যালয় এবং জাতীয় শিক্ষা পরিষদ| মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রধান মাধ্যম ছিল| কারিগরি শিক্ষার জন্য স্থাপিত হয় "বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট"| গড়ে ওঠে স্বদেশী কাপড় কল, সাবান  দেশলাইয়ের কারখানায়, ব্যাংক, বীমা কোম্পানী প্রভৃতি|

বাংলার স্বদেশী আন্দোলন বিভিন্ন দিক থেকে পূর্ববর্তী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে স্বতন্ত্র ছিল| এই আন্দোলনে যে আবেগ, যে স্ফূর্তি প্রতিভা দেখা গিয়েছিল, তা নিশ্চিতভাবে নিয়মতান্ত্রিক ছকে বাঁধা আন্দোলনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল|


তথ্যসূত্র

  1. সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
  2. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
  3. Ishita Banerjee-Dube, "A History of Modern India".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. বয়কট আন্দোলনের উৎপত্তি (আরো পড়ুন)
  2. বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম মনোভাব  (আরো পড়ুন)
  3. ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন  (আরো পড়ুন)
  4. ঊনবিংশ শতকে নারী সংক্রান্ত সমস্যা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐