বিংশ শতকের ত্রিশের দশক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে "সংকটের যুগ" নামে অভিহিত| এই সংকটের মূলে একদিকে যেমন একনায়কতন্ত্রী দেশগুলির জঙ্গী বিস্তার ধর্মী নীতির অবতারণা হয়, অন্যদিকে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে|
পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য সম্ভাব্য সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধমূলক নীতি গ্রহণ করলেন না| উপরন্ত ক্রমান্বয়ে ব্রিটেন ও তার সহযোগী ফ্রান্স আপোসমুখী নীতি অনুসরণে সচেষ্ট হয়| এই আপোসমুখী নীতিই "তোষণ নীতি" নামে পরিচিত|
এডলফ হিটলার |
ডাক টিকিট (হিটলার) |
জার্মানিতে হিটলারের উত্থান এবং নাৎসিবাদের প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে হিটলার যখন ইউরোপে একটার পর একটা দেশ গ্রাস করতে শুরু করেন এবং ভার্সাই সন্ধির শর্ত গুলিকে লঙ্ঘন করতে থাকেন, তখন দেখা যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রভৃতি পাশ্চাত্য দেশগুলিতে কোন বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিটলারকে প্রতিরোধ করার কোনো চেষ্টা করেননি| ব্রিটেন ও ফ্রান্সের এই নীতি জার্মানির শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল|
হিটলারের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন এবং জাপান ও ইতালির মতো দেশগুলির পররাজ্য গ্রাসের মাধ্যমে সম্প্রসারণের চেষ্টা সমগ্র বিশ্বে এক একটা অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল| এই অবস্থায় মহাযুদ্ধের একটা অশনি সংকেত ইউরোপের আকাশে-বাতাসে প্রভাবিত হচ্ছিল, তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নিরব এবং নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে উদাসীন ছিলেন| হিটলারকে বাধা দান করাতো দূরের কথা এই সময় ইংল্যান্ডের বিদেশ মন্ত্রী লর্ড হ্যালিফ্যাক্স একটা ঘড়োয়া সভায় সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসাবে হিটলারের ভূয়সী প্রশংসা করেন|
1935 সালের পর ব্রিটেনের দুই প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলী বল্ডউইন(1935-37) ও নেভিল চেম্বারলিন(1937-40) দীর্ঘ চার বছর ধরে জার্মানির প্রতি অন্তঃসার শূন্য তোষণ নীতি গ্রহণ করেন| জার্মানির প্রতি অন্তঃসার শূন্য তোষণ নীতি অনুসরণের প্রধান কারণ ছিল সাম্যবাদ প্রতিরোধ করা| কারণ ব্রিটেনের নেতৃত্বে ছিলেন কট্টর সাম্যবাদ বিরোধী| এই অবস্থায় হিটলার যখন সাম্যবাদী কমিউনিস্ট রাশিয়াকে তার প্রথম ও প্রধান শত্রু বলে ঘোষণা করেন, তখন ব্রিটেনের নেতৃবৃন্দ আশা প্রকাশ করেছেন যে, হিটলার শীঘ্রই সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন| তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি অনুসরণ করে হিটলারকে সন্তুষ্ট করে সাম্যবাদী রাশিয়ার অগ্রগতিকে রোধ করতে চেয়েছিলেন|
অনেকে মনে করেন যে, ইংল্যান্ডের সামরিক দুর্বলতাই চেম্বারলিনকে জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন| কারণ হিটলার ও মুসোলিনির জঙ্গিবাদী আগ্রাসনকে বাধা দেবার মতো সামরিক প্রস্তুতি ইংল্যান্ডের ছিল না| তাছাড়া ইংল্যান্ডের সামরিক প্রস্তুতির জন্য সময়ের দরকার ছিল| তাই তোষণ নীতি অনুসরণ করে ইংল্যান্ড তার সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কিছুটা সময় বের করে নিয়েছিলেন|
চেম্বারলিনের তোষণ নীতি কেবলমাত্র একটি Theory র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল| ত্রিশের দশকের শেষদিকে এই নীতি কার্যকর করার জন্য প্রয়াস চালানো হয়েছিল| কারণ এইসময় ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় দেশই হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আগ্রহী ছিল না| এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো হিটলারের মিত্র রাষ্ট্র ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি যখন 1935 সালে বলপূর্বক আবিসিনিয়া দখল করে নেয়, তখন কিন্তু ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড কোন দেশই এর প্রতিবাদ করেনি| ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের এই তোষণ নীতির ফলে আবিসিনিয়াকে ইতালির গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়নি|
1936 সালে হিটলার ভার্সাই সন্ধির অমান্য করে রাইনল্যান্ড অঞ্চলে তার সশস্ত্র বাহিনীকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিলেন| এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হবার কথা ফ্রান্সের, কিন্তু সেও চুপ করে রইলেন| ফ্রান্সের এই ভূমিকা লক্ষ্য করে ইংল্যান্ডও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন| ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের এই নিরবতার ফলে রাইনল্যান্ড অঞ্চল সহজেই জার্মানির হস্তগত হলো|
1937 সালের শেষের দিকে জার্মানির উগ্র জঙ্গি মানসিকতা প্রকাশ পায়| জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি ছিল হিটলারের দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা| শেষ পর্যন্ত 1938 সালের মার্চ মাসে হিটলারের আক্রমণ করে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখল করে নেয়| কিন্তু এত বড় একটা ঘটনাতেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স উদ্ভূত ভাবে অবিচল থেকে যান| হিটলারের এই অস্টিয়া আক্রমণ ইতালির মুসোলিনিকে ভীত করে তুলেছিল| এই ঘটনার পর মুসোলিনি তার ভাগ্যকে হিটলারের রথচক্রে এমন ভাবে সপে দিয়েছিলেন যে, সামান্য প্রতিবাদ করার মতো শক্তিও তার ছিল না|
অস্ট্রিয়া গ্রাস করার পর হিটলার চেকোস্লোভাকিয়া উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন| চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ নাগরিকই ছিল জার্মান জাতির| হিটলার সুদেতান অঞ্চলে জার্মানিদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করার পরিকল্পনা করেন| হিটলারের এই আগ্রাসী মনোভাব দেখে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত মুসোলিনির মধ্যস্থতায় 1938 সালে জার্মানির সঙ্গে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করেন| এই চুক্তি অনুসারে সুদেতান অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়| কিন্তু তা সত্ত্বেও 1939 সালে জার্মানি সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করে নেয়|
নাৎসি প্রতীক |
1936 সালে হিটলার ভার্সাই সন্ধির অমান্য করে রাইনল্যান্ড অঞ্চলে তার সশস্ত্র বাহিনীকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিলেন| এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হবার কথা ফ্রান্সের, কিন্তু সেও চুপ করে রইলেন| ফ্রান্সের এই ভূমিকা লক্ষ্য করে ইংল্যান্ডও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন| ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের এই নিরবতার ফলে রাইনল্যান্ড অঞ্চল সহজেই জার্মানির হস্তগত হলো|
1937 সালের শেষের দিকে জার্মানির উগ্র জঙ্গি মানসিকতা প্রকাশ পায়| জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি ছিল হিটলারের দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা| শেষ পর্যন্ত 1938 সালের মার্চ মাসে হিটলারের আক্রমণ করে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখল করে নেয়| কিন্তু এত বড় একটা ঘটনাতেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স উদ্ভূত ভাবে অবিচল থেকে যান| হিটলারের এই অস্টিয়া আক্রমণ ইতালির মুসোলিনিকে ভীত করে তুলেছিল| এই ঘটনার পর মুসোলিনি তার ভাগ্যকে হিটলারের রথচক্রে এমন ভাবে সপে দিয়েছিলেন যে, সামান্য প্রতিবাদ করার মতো শক্তিও তার ছিল না|
অস্ট্রিয়া গ্রাস করার পর হিটলার চেকোস্লোভাকিয়া উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন| চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ নাগরিকই ছিল জার্মান জাতির| হিটলার সুদেতান অঞ্চলে জার্মানিদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করার পরিকল্পনা করেন| হিটলারের এই আগ্রাসী মনোভাব দেখে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত মুসোলিনির মধ্যস্থতায় 1938 সালে জার্মানির সঙ্গে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করেন| এই চুক্তি অনুসারে সুদেতান অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়| কিন্তু তা সত্ত্বেও 1939 সালে জার্মানি সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করে নেয়|
বস্তুতপক্ষে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অনুসৃত এই তোষণ নীতি কিন্তু সফলতা লাভ করতে পারেনি| কারণ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের এই তোষণ নীতি একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিবাদী দেশগুলির পররাজ্য গ্রাসের লিপ্সাকে আরও বৃদ্ধি করেছিল এবং বিশ্ব শান্তিকে বিপন্ন করে তুলেছিল| এই অবস্থায় মিউনিখ চুক্তির পর হিটলারের কাছে একটি সংযোগ রক্ষাকারীর ভুখন্ড দাবি করলে পোল্যান্ড তা খারিজ করে দেয়| এরপর হিটলার 1939 সালের 1 লা সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পোল্যান্ড আক্রমণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়|
.......................................
মূল্যায়ন
অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদরা মনে করেন, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যদি প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদী জার্মানি ও ইতালির আগ্রাসী ক্রিয়া-কলাপ প্রতিরোধ করতো, তাহলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো যেত| তা না করে তারা একে একে হিটলারের বিভিন্ন দাবি, জার্মানির অস্ত্রসজ্জা, রাইনল্যান্ড দখল, অস্ট্রিয়া দখল প্রভৃতি মেনে নেয় এবং চেকোস্লোভাকিয়ার ব্যাপারে মিউনিখ চুক্তি সম্পাদন করে| এমনকি মুসোলিনি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে তারা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে| এরফলে তারা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে তুলে| অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর ইঙ্গ-ফরাসি এই তোষণ নীতিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন|তথ্যসূত্র
- Frank McDonough, "Conflict, Communism and Fascism".
- Ghosh Peu, "International Relations".
সম্পর্কিত বিষয়
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় উপনিবেশবাদের পতন তথা এর গুরুত্ব (আরো পড়ুন)
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জার্মানির বিভাজন তথা বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব (আরো পড়ুন)
- ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|