স্পেনের ঐক্যকরণে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা

পঞ্চদশ শতকের স্পেন ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত| আইবেরীয় উপদ্বীপে পাঁচটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, যথাক্রমে- কাস্তিল, অ্যারাগন, নাভারে, পর্তুগাল ও গ্রানাডা| 1469 সালে কাস্তিলের রাজকন্যা ইসাবেলার সাথে অ্যারাগনের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ফার্দিনান্দের বিবাহ হয়| 

1474 সালে ইসাবেলা কাস্তিলের শাসনভার লাভ করেন| সেই সময় থেকে ফার্দিনান্দ অ্যারাগনের রাজা হলে স্পেনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়| এই সময় থেকে 1516 সালে ফার্দিনান্দের মৃত্যু পর্যন্ত এরা দুজনে(ইসাবেলার মৃত্যু 1504) স্পেনে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যান| সন্দেহ নেই এদের প্রচেষ্টা অনেকাংশ সফল হয়েছিল|

ফার্দিনান্দ-ইসাবেলা
স্পেনের মানচিত্র


সমস্যাবলী

আধুনিক যুগে এসে স্পেনের সম্পদ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য ছিল না| দেশের মধ্যে যাজক ও অভিজাতরা ছিল শক্তিশালী, দেশের কৃষি জমির 90% ছিলো অভিজাতদের দখলে, অধিকাংশ মানুষ ছিল ভূমিহীন| অভিজাতরা প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করত| তারা রাজাকে কোন কর দিতো না, এমনকি নির্দিষ্ট প্রভাব বৃদ্ধি উদ্দেশ্যে তারা কালাট্রাভা(calatrava), আলকানটাভা(aleantava) ও সান্টিয়াগো(santiago) নামে সামরিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল|

ইংল্যান্ডের মতো কাস্তিল ও অ্যারাগনের করটেস(cortes) বা পার্লামেন্ট ছিল, কিন্তু করটেসের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন না, মনোনীত হতেন| দেশের বিচার-কার্য পরিচালনা করতেন জাস্টিসিয়া(justicia) নামে একটি প্রতিষ্ঠান| এই বিচারালয়ের বিচারক পদ ছিল বংশানুক্রমিক| এরা রাজার বিরুদ্ধে রায় দিতে কুন্ঠিত হতো না| এর ফলে দেশে অরাজকতা শুরু হয়েছিল| দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছিল| দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিবাণিজ্য দুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল| এমত অবস্থায় কাস্তিল ও অ্যারাগনের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল দুটি, যথা-
  1. দেশের মধ্যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন এবং রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করা| 
  2. দেশের অতি শক্তিশালী অভিজাতদের দমন করে দেশের সর্বত্র রাজার অধিকারী স্থাপন করা|
বলা বাহুল্য দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে রাজা ও রানী বণিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ করেছিল|


স্পেনের ঐক্যকরণে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার ভূমিকা

সিংহাসন আহরণ করে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা স্পেনের ঐক্যকরণে মনোনিবেশ করেন| এই সময় স্পেনের দক্ষিনে গ্রানাডা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল| ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা এই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে মুরদের পরাস্ত করেন এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন| এর ফলে গ্রানাডা কাস্তিল ও অ্যারাগনের সঙ্গে যুক্ত হয়| 

ফার্দিনান্দ বৈবাহিক সূত্রে নাভারা লাভ করেন এবং নাভারা স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হয়| একমাত্র পর্তুগাল ছাড়া সমগ্র আইবেরীয় উপদ্বীপ ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল| 


1. ভৌগোলিক আবিষ্কার ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা 

ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা স্পেনের নতুন শক্তি ও সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন| এদের অর্থ সাহায্য নিয়ে কলম্বাস নতুন দেশ আবিষ্কারের বেরিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেন, এই ঘটনা স্পেন তথা ইউরোপের ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করেছিল| এর ফলে স্পেনের সম্পদ নিঃসন্দেহে বেড়েছিল| 

ফার্দিনান্দ-ইসাবেলা
জাহাজ


দক্ষিণ আমেরিকার সোনা-রুপা শুধু অর্থনৈতিক জীবনে নয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটেছিল| দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত ভূভাগ জয় করে স্পেন অন্তত ধনী ও সম্পদশালী হয়েছিল| পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের মধ্যস্থতায়(1494) নতুন মহাদেশে স্পেন ও পর্তুগালের ঔপনিবেশিক অধিকার ভাগ হয়েছিল| স্পেন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সম্প্রসারণে আগ্রহী ছিল অন্য এক সালের মধ্যে কাটরিনার ও উত্তর আফ্রিকার এক বিস্তীর্ণ ভূভাগ জয় করতে সক্ষম হয়| 



2. রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি 

সর্বপ্রথম দেশের অভিজাততন্ত্রকে দমন করে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হন| তবে তারা দেশের সামরিক সংগঠনগুলি ভেঙ্গে দেননি, এগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন| সামরিক সংগঠন গুলির প্রধান মাস্টার হলেন ফার্দিনান্দ| তিনি হার্মানদাদ(Harmandad) নামক সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন|

পুরনো সংগঠনগুলিকে তিনি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাজে লাগিয়ে দেন| স্পেনের পার্লামেন্ট তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল| এই সময় দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আফ্রিকা থেকে প্রচুর সম্পদ এসেছিল, ফলে আর্থিক দিক থেকে স্পেন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল| জনগণ রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত হয়েছিল| রাজতন্ত্র শক্তিশালী চার্চের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল এবং রাজার নেতৃত্বে পোপের অনুমোদন নিয়ে "ইনকুই জিশন" স্থাপিত হয়|


3. বৈদেশিক নীতিতে সাফল্য লাভ 

ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলা বৈদেশিক নীতিতে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করে| ইউরোপীয় রাজ পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্পেনের রাজতন্ত্রকে ইউরোপীয় স্বীকৃত এনে দেন| ইসাবেলার কন্যা জোয়ানার বিবাহ হয়েছিল হ্যাপসর্বাগ রাজপুত্র ফিলিপের সঙ্গে|

পর্তুগাল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সঙ্গেও এই পরিবারে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল| রাজকন্যা ক্যাথরিনের সঙ্গে সপ্তম হেনরির পুত্র আর্থারের বিবাহ হয়| ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফরাসি রাজতন্ত্র ক্রমশ স্পেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে থাকে| দক্ষিণ ইতালির উপর কর্তৃত্ব নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে স্পেনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল|

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ফার্দিনান্দ "ভেনিস লীগ" গঠন করেন| এই মৈত্রী সংঘে যোগ দিয়েছিল পোপ, মিলানের ডিউক এবং নেপালের বিতাড়িত রাজা ফেরান্তে(Ferrante)| ফার্দিনান্দ স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে, উদীয়মান স্পেনের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ফ্রান্স, এই জন্য তিনি প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন| তবে 1516 সালে মৃত্যু হওয়ায় তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রভুত্ব হতে পারেননি| তার অবাধ্য কাজ শেষ করার দায়িত্ব নেন তার উত্তরাধিকারী সম্রাট পঞ্চম চার্লস|


মূল্যায়ন

ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলার নেতৃত্বে স্পেনে কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারীর রাজতন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল| উল্লেখ্য যে, স্পেনের রাজতন্ত্র তখনো শক্তিশালী ছিল না| ইসাবেলার মৃত্যুর পর কাস্তিল দুই বছর ফার্দিনান্দের কর্তৃত্বের বাইরে ছিল, ইসাবেলার কন্যা জোয়ানা কাস্তিলের রাণী হন| দুই বছর পর জোয়ানার শিশুপুত্র চার্লসের অভিভাবক হিসাবে ফার্দিনান্দ ক্ষমতা ফিরে পান|

এসব ঘটনা প্রমাণ করে স্পেনের রাজতন্ত্র যথেষ্ট সংহত ও ঐক্যবদ্ধ ছিল না| তবে পঞ্চদশ শতকের শেষে স্পেনে যে সামন্ততান্ত্রিক নৈরাজ্য চলছিল তা থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছিল| দুই ক্যাথলিক শাসকের নেতৃত্বে স্পেন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল| শাসন, বিচার, আইন ও সামরিক ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হয়| সমগ্র 16 শতক ধরে ইউরোপীয় রাজনীতিতে স্পেনের যে প্রাধান্য ছিল তা সূচনা হয়েছিল ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলার রাজত্বকালে(1479-1416)|



তথ্যসূত্র

  1. অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
  2. William Hickling Prescott, "History of the Reign of Ferdinand and Isabella, the Catholic, of Spain".

সম্পর্কিত বিষয়

সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐