ইউরোপে তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী| শিল্প বিপ্লবের ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়|
মূলধনীদের প্রাধান্য
শিল্প বিপ্লবের পুর্বে ভূম্যধিকারী অভিজাত গণ রাজনীতি ও প্রশাসনকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন| ফলে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করত| কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশের রাজনৈতিক চরিত্র পাল্টাতে থাকে| এবারে মূলধনী শ্রেণির শিল্প-মালিকরা তাদের অর্থ কৌলীন্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তারাই রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়|
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন
শ্রমিক শ্রেণীও রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে থাকে| ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু করে| একই ভাবে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশে শুরু হয় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন|
মালিক শ্রেণী শোষণের জর্জরিত হয়ে শ্রমিকেরা কালক্রমে উপলব্ধি করতে পারে যে, তাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন| শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু কিছু দাবি আদায়ে সমর্থ হয়| অবশ্য এতে শ্রমিক অসন্তোষ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি| ফলে শ্রমিক আন্দোলন স্থায়ী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়|
সমাজতন্ত্রবাদ
শিল্প বিপ্লবের ফলে "সমাজতন্ত্রবাদ" নামক নতুন রাজনৈতিক দর্শন বিকশিত হয়| সমাজে ধন বন্টন ব্যবস্থার বৈষম্য, শ্রমিকশ্রেণীর সীমাহীন দুর্দশা ও শিল্পপতিদের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়, তার সমাধান কল্পে কিছু কিছু চিন্তাবিদ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন (সেন্ট সাইমন, রবার্ট আওয়েন প্রমুখ)| এদের মতে, উৎপাদনের উপাদান সবার সমান অধিকার থাকা উচিত এবং আয় বণ্টনের সমতা থাকা জরুরি|
কার্ল মার্কস |
পরবর্তীতে কার্ল মার্কস এই মতবাদকে আরও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রচার করেন, তিনি এর নাম দেন "সাম্যবাদ"| শোষিত-বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণী খুব সহজেই সাম্যবাদে বা সমাজতন্ত্রবাদের আকৃষ্ট হয়| সাম্যবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে শ্রমিক শ্রেণী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে| অন্যান্য দেশেও এই রাষ্ট্রাদর্শ ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে|
জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি
শিল্প বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদের দাবিও জনপ্রিয় হয়ে উঠে| ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ন্যায় প্রাচীন রাষ্ট্রের আঞ্চলিক শুল্ক ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক আচার-ব্যবহারের বিভিন্নতাবাদের আদর্শ শক্তিশালী হয়ে ওঠে| শুল্ক সংঘের মাধ্যমে জার্মানির অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্য আসার পর বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত জার্মানির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে|
আন্তর্জাতিকতা বাদের উদ্ভব
জাতীয়তাবাদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে| পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ভাবাদর্শের পারস্পরিক বিনিময় সহজ হয়ে উঠে| ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতা বাদের উন্মেষ হয়|
পরিশেষে বলা যায় যে, শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজেদের দেশে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত পণ্যাদি বিক্রির জন্য ইউরোপ ও তার বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাজার খুঁজতে গিয়ে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করতে থাকে| এর ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়|এই উপনিবেশ দখলের লড়াই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর সৃষ্টি করে|
তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
- Lewis Helfand, "The Industrial Revolution".
- Robert C. Allen, "The Industrial Revolution: A Very Short Introduction".
সম্পর্কিত বিষয়
- কৃষি মূলধন ও শিল্প মূলধনের মধ্যে পার্থক্য (আরো পড়ুন)
- মার্কেন্টাইলবাদ কি এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপের এর প্রভাব (আরো পড়ুন)
- বৈজ্ঞানিক বিপ্লব (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................