ভিয়েনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইউরোপীয় নেতৃবর্গ ভিয়েনা যুক্তিকে স্থায়িত্ব দান, ইউরোপে শান্তি রক্ষা এবং নেপোলিয়ানের পুনরায় উত্থান রোধ- এই তিনটি প্রধান সমস্যা সমাধানের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন| এর নাম দেওয়া হয় ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা concert of Europe| মূলত দুটি চুক্তির মাধ্যমে এই ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গড়ে ওঠে| যথা- 1.পবিত্র চুক্তি ও 2.চতুর্মুখী চুক্তি
পবিত্র চুক্তি (Holy Alliance)
পবিত্র চুক্তির উদ্ভাবক হলেন স্বপ্নবিলাসী, ভাবপ্রবণ ও আদর্শবাদী রুশ জার আলেকজান্ডার| তিনি মনে করতেন যে, ফরাসি বিপ্লবের ন্যায় প্রজা বিদ্রোহ ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্ম শাস্ত্র বিরোধী| ইউরোপীয় জনগণ যদি খ্রিষ্টীয় ধর্মনীতি অনুসারে রাজ্য শাসন এবং বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করেন, তবে ইউরোপের সকল অশান্তি দূর হবে বলে মনে করতেন|
পবিত্র চুক্তির আদর্শ
বাইবেলের "নিউ টেস্টামেন্ট" এর খ্রিস্টীয় রাজ ও ধর্ম সম্পর্কে যেসব আদর্শের উল্লেখ আছে রুশ জার আলেকজান্ডার ইউরোপীয় রাজন্যবর্গকে সেগুলি পালনের আহ্বান জানান এবং 1815 সালের 26 শে সেপ্টেম্বর পবিত্র জোটের ঘোষণা করেন| এই চুক্তিতে বলা হয়-
- ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ পরস্পরকে খ্রিস্টীয় সমাজের অধীনে ভ্রাতা হিসেবে বিবেচনা করবেন|
- নিজ নিজ প্রজাদের তারা সন্তান হিসেবে মনে করবেন|
- ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ/তারা "ন্যায়, মানবপ্রেম ও শান্তি"-কে অবলম্বন করে রাজ্য শাসন করবেন|
- দেশ শাসনের সঙ্গে তারা ধর্মের অন্তর্নিহিত শর্ত গুলি পালন করবেন|
ইংল্যান্ড, পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের প্রায় সকল রাষ্ট্রই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে| কিন্তু এই চুক্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি| আসলে এই চুক্তি বাস্তব বর্জিত ছিল, তাই সমসাময়িক রাজনৈতিকরা এর উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি| এই চুক্তির সঙ্গে জনগণের কোন সম্পর্ক ছিল না| অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটানিক একে অর্থহীন বাগাড়ম্বর বলে বিদ্রুপ করেন| অতঃপর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিরোধিতা এবং রুশ জার আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ফলে পবিত্র চুক্তির অবসান ঘটে|
চতুর্মুখী চুক্তি (Quadruple alliance)
পবিত্র চুক্তি বিফলতার পর ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠনের জন্য বাস্তববাদী মেটারনিক চতুর্মুখী চুক্তির খসড়া রচনা করেন| 1815 সালে 20 ই নভেম্বর ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং প্রাশিয়ার মধ্যে চতুর্মুখী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়| ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বলতে পবিত্র চুক্তি ও চতুর্মুখী চুক্তি উভয়কে বুঝালেও বাস্তবে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় চতুর্মুখী চুক্তির দ্বারাই স্থাপিত ছিল|
চতুর্মুখী চুক্তির উদ্দেশ্য
চতুর্মুখী চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল-
- ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রাখা|
- ফরাসি সিংহাসনে কোনদিনই যাতে বোনাপার্ট পরিবারের কেউই বসতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা|
- ইউরোপে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা|
- ফরাসি বিপ্লবের মতো বিপর্যয়কারী ও ধ্বংসাত্মক শক্তির হাত থেকে রক্ষা করা|
- নিজ নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করা|
1818-1825 সালের মধ্যে চতুর্মুখী চুক্তির সর্বমোট পাঁচটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়| 1825 সালে সেন্ট পিটার্স বার্গ সম্মেলনে পরেই ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন ঘটে|
চতুর্মুখী চুক্তির ব্যর্থতা কারণ
চতুর্মুখী চুক্তির ব্যর্থতার পশ্চাতে নানা কারণ ছিল|
- ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক স্বার্থ, উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা এবং সন্দেহ কখনোই তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেয়নি| যেমন- জারের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের অগ্রগতি রোধ করা, আবার ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য ছিল বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি প্রতিরোধ করা|
- বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ ছিল| ইংল্যান্ড ছিল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি ছিল স্বৈরাতান্ত্রিক| গণতান্ত্রিক ও উদারপন্থী ইংল্যান্ডের পক্ষে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একসঙ্গে চলা সম্ভব ছিল না|
পরিশেষে বলা যায়, তীব্র নেপোলিয়ান ভীতি ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল| কিন্তু কালক্রমে এই ভীতি দূর হয়ে গেলে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাত প্রকট হয়ে ওঠে এবং চতুর্মুখী শক্তির পতন হয়|
তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ি, "ইউরোপের ইতিবৃত্ত"
- Georges Lefebvre, "The French Revolution".
- Hilaire Belloc, "The French Revolution".
সম্পর্কিত বিষয়
- ফরাসি বিপ্লবের কারণ (আরো পড়ুন)
- ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব (আরো পড়ুন)
- নেপোলিয়ন কে কেন ফরাসি বিপ্লবের শিশু বলা হয় (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................