প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল ছিল গভীর ও সুদূর প্রসারী| মূলত ইউরোপীয় বিবাদ-বিসংবাদকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সমগ্র বিশ্বই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল| এরফলে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়|
|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব
- বিপুল সৈন্য ক্ষয় ও অসংখ্য জীবননাশ: এই সর্বগ্রাসী মহাযুদ্ধে যে জীবনহানি হয়েছিল পূর্ববর্তী কোন যুদ্ধে তা কল্পনাও করা যায়নি| মোট সাড়ে ছয় কোটি অংশগ্রহণকারী সৈন্য মধ্যে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ সৈন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছিল| তাছাড়া যুদ্ধের সময় এবং তার অব্যবহিত পরে খাদ্যাভাব, রোগ ও মহামারীতে যে বিরাট সংখ্যক সাধারণ মানুষের প্রাণনাশ হয়েছিল, তার কোন পরিমাপ হয়নি|
- অর্থ ও সম্পদের অপচয়: এই যুদ্ধে ঋণ-সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল মারাত্মক| যুদ্ধের সর্বমোট ব্যয় হয়েছিল 27 হাজার কোটি ডলার| এই অর্থ ব্যয় হয়েছিল মানুষের প্রাণনাশ ও ধ্বংসকার্যে| পৃথিবীতে ইউরোপের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিনষ্ট হয় এবং যুদ্ধের পর আমেরিকা পৃথিবীর মহাজন দেশে পরিণত হয়| এত অর্থের অপচয়ের ফলে পরবর্তীকালে ইউরোপে তীব্র অর্থ সংকট দেখা দেয়|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রভাব
- নতুন রাষ্ট্রের জন্ম: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়| যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে চারটি বৃহৎ সাম্রাজ্য এবং রাজবংশের পতন ঘটে| এই সাম্রাজ্যগুলি হল- রাশিয়া(রোমানভ বংশ), জার্মানি(হোহেন জোলার্ন বংশ), অস্ট্রো-হাঙ্গেরি(হ্যাপসবার্গ বংশ) ও তুরস্ক(অটোমান বংশ)| এইসব সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠে বেশকিছু নতুন রাষ্ট্র বা কিছু পুরনো রাষ্ট্র পুনগঠিত হয়| যেমন- পোল্যান্ড, বোহেমিয়া, রোমানিয়া, লিথুনিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া প্রভৃতি|
- জাতীয়তাবাদের জয়: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রাজনৈতিক ফল ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিস্তার| 1815 সালের ভিয়েনা সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ যেখানে জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে সমূলে উৎপাটন করতে সচেষ্ট ছিলেন| যেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে(1919) জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়| এরফলে বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলি ভেঙে এক জাতি গোষ্ঠী ও এক ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে জাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে| পূর্বপুরুষ সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়| পোলদের একত্রে করে পোল রাষ্ট্রের পুনর্জীবন সাধন করা হলো| অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও হাঙ্গেরি রাষ্ট্র গঠন করা হলো| জাতীয়তার ভিত্তিতেই আলসাস-লোরেন ফ্রান্সকে, শ্লেজউইগ ডেনমার্ককে, ট্রিয়েস্ট ইতালিকে দেওয়া হল|
- গণতন্তের প্রসার: জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ভাবধারাও প্রসার ঘটে| পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক, জার্মানি, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়|
- একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব: যুদ্ধ অবসানে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির নানারকম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়| গণতান্ত্রিক পথে এইসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়| উদাহরণ হিসেবে জার্মানি, ইতালি, স্পেন এর কথা বলা যায়|
- আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার: যুদ্ধের পর জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পায়| মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন 14 দফার নীতির উপর ভিত্তি করে League of Nations বা জাতিসংঘ গঠিত হয়| এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক প্রভাব
- নারী সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে| নারীমুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ| যুদ্ধে ক্ষেত্রে অগণিত তুরস্কের মৃত্যু ঘটে| এরফলে কর্মক্ষেত্রে যুবকের অভাবে বিভিন্ন দেশে মেয়েরা কলকারখানায়, স্কুল-কলেজে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তারা পুরুষদের সমান মর্যাদা দাবি করতে থাকে|
- শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্ব: যুদ্ধের সময় শ্রমিক শ্রেণীর নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে| তারাই কলকারখানায় যুদ্ধের অস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন করত| তারা বুঝতে পারে যে, জাতীয় জীবনে তাদের ভূমিকা নেহাত কম নয়|যুদ্ধের পরে তারা নিজেদের জন্য নানা ধরনের অধিকার দাবি করতে থাকে এবং সরকারও সেসব দাবি মেনে নেয়|
তথ্যসূত্র
- DK, "World War I".
- David Stevenson, "1914 - 1918: The History Of The First World War".