মেইজি যুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব 1889 সালে একটি সংবিধান রচনা করা| শোগুন শাসন অবসানের পরেই জাপানের রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের ফলে আধুনিক জাপান গড়ে তোলার জন্য সংসদীয় ধাঁচে একটি সংবিধান রচনার প্রয়োজনীয়তা মেইজি সরকার অনুভব করে|
সংবিধান রচনার দায়িত্ব নেন কাউন্ট ইটো| এই উদ্দেশ্যে ইটো আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন এবং শেষ অব্দি জার্মানির রক্ষণশীল সংবিধান তাকে আকৃষ্ট করে| স্বাভাবিকভাবেই তাঁর নেতৃত্বে যে সংবিধান তৈরি হয়, সেটি রক্ষণশীল ছিল| 1889 সালের 11 ই ফেব্রুয়ারি মেইজি সম্রাট নতুন সংবিধানটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবর্তন করেন|
সংবিধান রচিত হয় মূলত দুটি আদর্শ অনুসারে, যথাক্রমে-
- সম্রাটের পুনর্বাসনের আদর্শ
- সামন্ততান্ত্রিক আদর্শ
প্রথম আদর্শ অনুযায়ী সম্রাট বিরাজিত থাকবেন সামন্ত ক্ষমতা এবং যাবতীয় অনুগ্রহ প্রদর্শনের উৎস হিসেবে| দ্বিতীয় আদর্শ অনুসারে সম্রাটের সাংবিধানিক ক্ষমতাসমূহ সম্রাট স্বয়ং প্রয়োগ না করে তার পরিবর্তে প্রয়োগ করবেন তার প্রতিনিধিগণ| মেইজি সংবিধানে মোট 76 টি অনুচ্ছেদ সম্মিলিত এবং 7 টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল|
এইসব ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্রাট মন্ত্রী মন্ডলী ও প্রিভি কাউন্সিল নামে দুটি পরামর্শদাতা সমিতির সঙ্গে একযোগে কাজ করতেন| প্রধানমন্ত্রী ও 12 জন বিভাগীয় মন্ত্রী নিয়ে মেইজি মন্ত্রীসভা গঠিত ছিল| মন্ত্রীরা সম্রাট কর্তৃক মনোনীত হতেন| মন্ত্রীদের মুখ্য দায়িত্ব ছিল সম্রাটকে উপদেশ দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনার সাহায্য করা| মন্ত্রী মন্ডলীকে তাদের কাজের জন্য সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হতো|
প্রিভি কাউন্সিলের মোট সদস্য ছিল 26 জন| কাউন্সিলের মুখ্য দায়িত্ব ছিল সম্রাটকে শাসনকার্যে পরামর্শ দান করা| এই 26 জন সদস্যের মধ্যে একজন সভাপতি, একজন সহ-সভাপতি, 12 জন বিভাগীয় মন্ত্রী ও 12 জন সম্রাট কর্তৃক মনোনীত হতেন|
রাজার ক্ষমতা
মেইজি সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সম্রাটই ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী| তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র এবং তার পদমর্যদা ছিল অলঙ্ঘনীয়| সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ে রাজার মর্যাদা ও ক্ষমতা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে| প্রশাসনিক, আইন-প্রণয়ন সংক্রান্ত ও বিচার সংক্রান্ত সমস্ত ক্ষমতার তিনিই ছিলেন একমাত্র অধিকারী| এতে প্রমাণিত যে, মেইজি সংবিধানে বিভিন্ন বিভাগের শাসন বিষয়ে কোনো কঠোর পৃথকীকরণের ব্যবস্থা ছিল না| তাছাড়া রাজার জরুরী বিধান করারও অধিকার ছিল| অবশ্য এই জরুরি বিধি কোন অবস্থাতেই প্রচলিত আইন পরিবর্তন করতে পারত না|এইসব ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্রাট মন্ত্রী মন্ডলী ও প্রিভি কাউন্সিল নামে দুটি পরামর্শদাতা সমিতির সঙ্গে একযোগে কাজ করতেন| প্রধানমন্ত্রী ও 12 জন বিভাগীয় মন্ত্রী নিয়ে মেইজি মন্ত্রীসভা গঠিত ছিল| মন্ত্রীরা সম্রাট কর্তৃক মনোনীত হতেন| মন্ত্রীদের মুখ্য দায়িত্ব ছিল সম্রাটকে উপদেশ দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনার সাহায্য করা| মন্ত্রী মন্ডলীকে তাদের কাজের জন্য সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হতো|
প্রিভি কাউন্সিলের মোট সদস্য ছিল 26 জন| কাউন্সিলের মুখ্য দায়িত্ব ছিল সম্রাটকে শাসনকার্যে পরামর্শ দান করা| এই 26 জন সদস্যের মধ্যে একজন সভাপতি, একজন সহ-সভাপতি, 12 জন বিভাগীয় মন্ত্রী ও 12 জন সম্রাট কর্তৃক মনোনীত হতেন|
ডায়েট (Diet)
মেইজি সংবিধানের সর্বাপেক্ষা অভিনব অংশ ছিল ডায়েট(Diet) বা জাতীয় সংসদ| এই সংসদ ছিল দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট, যথা-- উচ্চকক্ষ বা House of peers
- নিম্ন কক্ষ বা House of Representatives
উচ্চকক্ষ বা House of peers
উচ্চ কক্ষের সদস্য সংখ্যা ছিল 368 জন| রাজপরিবারের সভ্য, প্রিন্স, মারকুইস শ্রেণী ভূক্ত, অভিজাত বংশীয় ব্যক্তি, কাউন্ট, ভাই কাউন্ট, ব্যারণ সম্প্রদায় ব্যক্তি এবং কয়েকটি বিশেষ শ্রেণী থেকে সম্রাট কর্তৃক উচ্চ কক্ষের সদস্যরা মনোনীত হতেন| এককথায় বলা যায়, উচ্চকক্ষ ছিল একটি রক্ষণশীল সংস্থা| উচ্চকক্ষের সদস্যরা সবসময় তাদের শ্রেণীর স্বার্থকে রক্ষা করার চেষ্টা করত|
নিম্ন কক্ষ বা House of Representatives
নিম্ন কক্ষের সদস্যরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন| এদের সংখ্যা ছিল 379 জন| কার্যকাল ছিল চার বছর|
আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল ডায়েটের হাতে| উভয় কক্ষের কোন বিল অনুমোদন করলে, সেটি সম্রাটের স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হতো| সম্রাট স্বাক্ষর দিলেই বিলটি আইনে পরিণত হতো| সম্রাট ইচ্ছা করলে যেকোনো বিলকে ভেটো প্রয়োগ দ্বারা বাতিল করতে পারতেন| উভয় কক্ষের অধিবেশন বসতো স্বতন্ত্রভাবে| ডায়েটের অধিবেশন না থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সম্রাট নিরাপত্তা রক্ষার্থে জরুরী বিধান বা Ordinance জারি করতে পারতেন|
মন্ত্রিসভার অনুমতি ব্যতিরেকে কয়েকটি বিশেষ প্রথাগত আয়-ব্যয়ের অঙ্ক ছাড়া ডায়েট প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় পরিবর্তন করতে পারত না| তাছাড়া জরুরি খরচ মেটানোর জন্য সরকারের একটি সঞ্চিত তহবিল থাকতো| মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, সরকারি আয়-ব্যয়ের উপর ডায়েটের বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল না|
আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল ডায়েটের হাতে| উভয় কক্ষের কোন বিল অনুমোদন করলে, সেটি সম্রাটের স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হতো| সম্রাট স্বাক্ষর দিলেই বিলটি আইনে পরিণত হতো| সম্রাট ইচ্ছা করলে যেকোনো বিলকে ভেটো প্রয়োগ দ্বারা বাতিল করতে পারতেন| উভয় কক্ষের অধিবেশন বসতো স্বতন্ত্রভাবে| ডায়েটের অধিবেশন না থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সম্রাট নিরাপত্তা রক্ষার্থে জরুরী বিধান বা Ordinance জারি করতে পারতেন|
রাজস্ব বিভাগ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধানাবলী
মেইজি সংবিধানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যে, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার সব থেকে কার্যকরী হাতিয়ার হল জাতীয় সংসদে সরকারের বাৎসরিক বাজেট অনুমোদন না করা| কিন্তু জাপানের সংসদ অর্থাৎ ডায়েট কোন বছরের বাজেট অনুমোদন না করলে আগের বছরের বাজেট চালু রাখার ক্ষমতা মন্ত্রিসভাকে দেওয়া হয়|মন্ত্রিসভার অনুমতি ব্যতিরেকে কয়েকটি বিশেষ প্রথাগত আয়-ব্যয়ের অঙ্ক ছাড়া ডায়েট প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় পরিবর্তন করতে পারত না| তাছাড়া জরুরি খরচ মেটানোর জন্য সরকারের একটি সঞ্চিত তহবিল থাকতো| মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, সরকারি আয়-ব্যয়ের উপর ডায়েটের বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল না|
বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন
বিচারের জন্য মেইজি সংবিধানে দুই ধরনের আদালত ছিল যথাক্রমে,- সাধারণ বিচারালয়
- প্রশাসনিক বিচারালয়
সাধারণ বিচারালয় অর্থে বোঝাত স্থানীয় বিচারালয়, জেলা বিচারালয়, পুনর্বিবেচনার জন্য বিচারালয়(আপিল কোর্ট) এবং সর্বোপরি মহাধর্মকিকরণ(সুপ্রিম কোর্ট)| সাধারণ বিচারালয়ে অসামরিক ও সাধারণ অপরাধের বিচার হতো| প্রশাসনিক বিষয়গুলির বিচার হতো প্রশাসনিক বিচারালয়ে| রাজদ্রোহী মূলক অপরাধের বিচার হতো সুপ্রিম কোর্টে|
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের নানা দাবি সংবিধানের মেনে নেওয়া হয়| যথাক্রমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রকাশ্যে জনসমাজের স্বাধীনতা, যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরীতে নিয়োগের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি| কিন্তু এসব অধিকার সংবিধান ভিত্তিক ছিল না, ছিল দেশের আইন ভিত্তিক|
মেইজি সংবিধানের প্রকৃতি
একথা অনস্বীকার্য যে, মেইজি সংবিধান জাপানের সর্বপ্রথম আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির সূচনা করে| কিন্তু একথা সত্য যে, এই গণতন্ত্রের কোন গভীর ভিত্তি ছিল না| সংবিধানের বাহ্যিক রূপরেখা সংসদীয় শাসন সুলভ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার কাঠামো ছিল গোষ্ঠীতন্ত্র বা অলিগার্কি সুলভ| সংসদীয় শাসন পদ্ধতিতে এই বিধান অচল|
সংসদীয় শাসনতন্ত্রে আইন সভার দুটি কক্ষের সমান অধিকার থাকে না| কিন্তু মেইজি সংবিধান আইন সভার দুটি কক্ষেরই সমান অধিকার ছিল| এই সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের সংবিধান ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার অধিকার ছিল না|
উপরন্তু বলা যায় যে, সংবিধান সংশোধনের প্রাথমিক প্রস্তাব পেশ করার অধিকার ডায়েটের ছিল না, যে অধিকারগুলি ছিল সম্রাটের এবং তার মন্ত্রিসভার|জনগণের রাজনৈতিক অধিকার সমূহ সংবিধান ভিত্তিক ছিল না, সেগুলি ছিল বিধিবদ্ধ ভিত্তিক| মেইজি সরকার যে কোনো অজুহাতে অধিকারগুলি বাতিল করার ক্ষমতা রাখতেন|
তাছাড়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না| এর ফলে ভবিষ্যতে জাপানের পক্ষে মারাত্মক হয়েছিল| এইসব উদাহরণ উল্লেখ করে বলা যায়, মেইজি সংবিধানে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, মন্ত্রিসভা, বিচার বিভাগ ইত্যাদি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা থাকলেও সংবিধানের অন্তর্নিহিত রূপটি ছিল অলিগার্কি সুলভ অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিচালিত শাসনতন্ত্রের রূপ| মোটকথা মেইজি সংবিধানের রুপরেখা গণতান্ত্রিক নয়|
যদিও মেইজি সংবিধান গণতান্ত্রিক ছিল না| সংবিধানটি ছিল অভিজাত তান্ত্রিক, কিন্তু তা সত্ত্বেও জাপানের পার্লামেন্টের সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ| এককথায় বলা যায় 1889 সালের জাপানি সংবিধানে জাপানের রাজনৈতিক জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল|
.......................................
তথ্যসূত্র
- ড. হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, "জাপানের ইতিহাস"
- R. H. P. Mason, "A History of Japan".
- Kenneth Henshall, "A History of Japan: From Stone Age to Superpower".
সম্পর্কিত বিষয়
- মেইজি যুগে জাপানে প্রবর্তিত নতুন ভূমি ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- মেইজি পুনর্গঠন এর প্রকৃতি কিরূপ ছিল (আরও পড়ুন)
- জাপানের ইতিহাসে ডাইমিয়ো এবং সামুরাই বলতে কি বুঝায় (আরও পড়ুন)
- মেইজি যুগের মুদ্রা ব্যবস্থার অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|