ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চীনে ক্ষমতাসীন মাঞ্চু রাজবংশকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হতে হয়, যেটি তাইপিং বিদ্রোহ(1850 –1864) বলে পরিচিত| বিভিন্ন কারণের সমষ্টিগত ফল ছিল তাইপিং অভ্যুত্থান|
সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি সমষ্টি ক্ষেত্রেই মাঞ্চু সরকার ছিল সমস্যায় জর্জরিত| এই সমস্ত জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে মাঞ্চু সরকারের ব্যর্থতা, এই বিদ্রোহের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়েছিল|
তাইপিং বিদ্রোহের কারণ
1) সামাজিক সংকট
চীনের সমাজ ছিল কৃষি ভিত্তিক| সামাজিক শৃঙ্খলা স্বাভাবিকভাবেই নির্ভরশীল থাকতো জমির সুস্থ বন্টনের উপর, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চীনে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়| যেখানে 1741 সালে চীনের জনসংখ্যা ছিল 143 মিলিয়ন, সেখানে 1856 সালে জনসংখ্যা এসে পৌঁছায় 430 মিলিয়নে অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় 200 শতাংশ|
কিন্তু কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ সমান অনুপাতে বাড়েনি| জনসংখ্যা ও জমির পরিমাণ বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য হেতু আবাদি জমি অত্যাধিক হ্রাস পায়| আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় কৃষকের সাংসারিক জীবনে অচলাবস্থা দেখা যায়| আর্থিক সংকটের হাত থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাধ্য হয় কৃষক ধনী ব্যক্তির কাছে জমি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করত| এভাবে জমি হস্তান্তরের ফলে জনসংখ্যার 60-90 শতাংশ মানুষ জমিহীন হয়ে পড়ে|
এইরূপ পরিবার অর্থ সংস্থানের জন্য চড়া সুদে অর্থ ধার করে| সুদ পরিশোধের উপায় নিঃশোষিত হলে তারা শ্রমিক ও জাহাজে খালাসির পেশা গ্রহণ করে| আবার কেউ কেউ দুর্ভিক্ষের জীবন বেছে নেয়| দেশে যদি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকতো, তবে তারা শিল্প উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারতো| এরূপ আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তাদের হতে হতো না| কিন্তু চীনের অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক ছিল না, সেইজন্য এই শ্রেণীর মানুষ বিদ্রোহে প্রবল হয়ে ওঠে|
2) অর্থনৈতিক সংকট
বেআইনি আফিমের ক্রমবর্ধমান আমদানি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করেছিল| আফিম আমদানির মূল্য হিসেবে চীন থেকে প্রচুর পরিমাণ রৌপ্য বিদেশে চলে যেত| দেশের রৌপ্য বিদেশে চলে যাওয়ায় রৌপ্য মুদ্রা ও তাম্র মুদ্রার বিনিময় মূল্য বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়|
অষ্টাদশ শতকে 1 টিল রৌপ্য মুদ্রার বিনিময় মূল্য ছিল 1000 তাম্র মুদ্রা এবং 1845 সালে 1 টিল রৌপ্য মুদ্রার বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় 2000 তাম্র মুদ্রার অধিক| তাম্র মুদ্রা ক্রয় ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি হ্রাস পায়, তখন ক্রয়-বিক্রয়ের বাজারে তাম্র মুদ্রা বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে চালু থাকায় সাধারণ চীনাবাসী আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয় এবং জনগণের মনে অসন্তোষ পুঞ্জিভূত হতে থাকে|
এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি পণ্যের উপর 5% বেশি বেশি শুল্ক ধার্য করার স্বাধীনতা না থাকায় এবং চীনের বিভিন্ন বন্দর বিদেশীদের কাছে খুলে দেওয়ায় বিদেশী পণ্য চীনের বাজার দখল করে| বিদেশী পণ্যের এই ধরনের ক্রমবর্ধমান আমদানির ফলে চীনের দেশীয় শিল্প বিশেষত অগণিত মানুষের ভরসা বয়ন শিল্প প্রচন্ডভাবে মার খায়| চীনের স্বয়ম্বর গ্রামীণ অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ ছিল বয়ন শিল্প| এই শিল্পের অবনতি ঘটলে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ে|
3) প্রাকৃতিক দুর্যোগ
চীনের অর্থনৈতিক দুর্গতি আরো বেড়ে যায় বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টির ফলে| 1840 এর দশকের শেষের দিকে চীনে কতগুলি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল| 1847 সালে হেনান অঞ্চলে, 1849 মধ্য ইয়াংসি উপত্যকায় এবং 1850 সালে হুনানের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ জনজীবন বিপন্ন করে তুলেছিল| এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছিল|
4) রাজনৈতিক কারণ
দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত মাঞ্চু প্রশাসন তাইপিং বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করেছিল| দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যতই বাড়ছিল, ততই যেন মাঞ্চু শাসনতন্ত্র বিফল হয়ে যাচ্ছিল| ক্রমবর্দ্ধমান সমস্যার সমাধানে অধিকাংশই শাসক সততার সাথে শাসন করা পরিবর্তে আপন স্বার্থ রক্ষায় অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠে| ফলে দেশের দুর্নীতিতে ভরে যায়| যে মুষ্টিমেয় রাজপুরুষের ছিলেন, তারাও নিজ কর্তব্য পালন না করে বৌদ্ধ দর্শন ও সাহিত্য আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটাতেন|
এই সময় মাঞ্চু সামরিক ব্যবস্থাতেও অবগতি দেখা দেয়| উলান তাই নামে জনৈক উচ্চপদস্থ মাঞ্চু সামরিক নেতা মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রথম আফিম যুদ্ধে অপমানজনকভাবে পরাজিত হবার ফলে মাঞ্চু সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে গিয়েছিল| সাধারণ সৈন্যরা নেতাদের নির্দেশ মানতো না| সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা মাঞ্চু শাসন বিরোধী দরিদ্র মানুষদের বিদ্রোহ ঘোষণা করতে সাহস জুগিয়েছিলেন|
উপরের কারণগুলি ছাড়া চীনের বিশেষ পরিস্থিতি বিদ্রোহের সহায়ক হয় এবং এখানেই তাইপিং বিদ্রোহের জন্ম হয়| ইয়াংসির দক্ষিনে ইউরোপীয়দের বসবাসের ফলে সেখানে পশ্চিমের প্রভাব পড়েছিল, বিশেষত খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যাবলী তাইপিং বিদ্রোহীদের অনেকাংশে প্রবাহিত করেছিল| ওই অঞ্চলের দরিদ্র ভয়াভহ আকার ধারণ করেছিল| এই দক্ষিণ চীনে হক্কা(Hakka) নামে একটি সম্প্রদায় বিদ্রোহের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল| এই হক্কা সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল উত্তর চীনের অধিবাসী এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত, ফলে আর্থিক সংকট বাড়ার সাথে সাথে স্থানীয় অখ্রিস্টান অধিবাসীদের সাথে হক্কাদের সংঘর্ষ ক্রমশই বেড়েছিল| তাইপিং বিদ্রোহের নেতা হুং-শিউ-চুয়ান(hung-hsiu-chuan) এবং তার প্রধান সহকর্মীরা সকলেই হক্কা সম্প্রদায়ের ছিলেন|
এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চীন নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়| সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, সামরিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, জনসংখ্যার চাপ, মাথাপিছু আবাদী জমির অপর্যাপ্ততা, কৃষক শ্রেণীর দুর্নীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়- সবকিছু সম্মিলিতভাবে চীনে আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে| যদিও হুং ছিলেন এই বিদ্রোহের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু এই অভ্যুত্থানের স্রষ্টা তিনি ছিলেন না| চীনের সমকালীন পরিস্থিতিই এই বিদ্রোহের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল|
এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চীন নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়| সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, সামরিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, জনসংখ্যার চাপ, মাথাপিছু আবাদী জমির অপর্যাপ্ততা, কৃষক শ্রেণীর দুর্নীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়- সবকিছু সম্মিলিতভাবে চীনে আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে| যদিও হুং ছিলেন এই বিদ্রোহের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু এই অভ্যুত্থানের স্রষ্টা তিনি ছিলেন না| চীনের সমকালীন পরিস্থিতিই এই বিদ্রোহের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল|
তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি
তাইপিং অভ্যুত্থানের প্রকৃতি সম্বন্ধে ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন| ভারতীয় পন্ডিত মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিখ্যাত "Revolution and Counter-revolution in China" গ্রন্থে তাইপিং বিদ্রোহকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন| তিনি বলেছেন যে, তাইপিং বিদ্রোহের সময়ে চীনে অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের মত বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি| চীনের জেন্টির এই বিদ্রোহের কোন ভূমিকা ছিল না|
.
তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই যে কথাটি মনে হয় সেটি হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ে তাইপিং আন্দোলন ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন| বৌদ্ধ, তাও এবং কনফুসীয় ধর্ম বিরোধী এই আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মাধ্যমে সমস্ত মানুষকে চীনা রূপে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা এবং একনায়কতন্ত্রের অধীন দেশে একটি ধর্মরাজ্য স্থাপন করা| আন্দোলন চলাকালীন তাইপিংরা পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করেন| বহু বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়|
চীনের সাম্যবাদী ঐতিহাসিকরা তাইপিং আন্দোলনকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কৃষি বিপ্লব রূপে গণ্য করেছিল| হুং ছিলেন কৃষক পরিবার ভুক্ত এবং তার অনুগামীদের মধ্যে কৃষকরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ| বিদ্রোহীরা অত্যাচারী জমিদার ও জনস্বার্থ বিরোধী রাজপুরুষদের নিহত করেছিল| জমির মালিক থেকে আরম্ভ করে ঋণপত্র ও মহাজনের কাছে রক্ষিত যাবতীয় নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল| এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তাইপিং বিদ্রোহ সামন্ততন্ত্রের বিরোধী সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করেছিল| গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা তাইপিং এর আন্দোলনকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে প্রথম কৃষি বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন|
তবে তাইপিং বিদ্রোহকে কেবলমাত্র কৃষক বিদ্রোহ রূপে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত নয়| তাইপিং বিদ্রোহের মাঞ্চু বিরোধী ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ| তাইপিং বিদ্রোহের তিন প্রধান নেতা যে মাঞ্চু বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, সেই জেহাদ ছিল জাতীয়তাবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত| এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল, চীনকে মাঞ্চুদের অপশাসন থেকে মুক্ত করা| আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের শ্লোগান ছিল, চিং বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিং বংশকে ফিরিয়ে আনা|
আবার কেউ কেউ তাইপিং বিদ্রোহকে সাম্যবাদী আন্দোলনের পূর্বাভাস বলে অভিহিত করেছেন| বিদ্রোহীরা নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী ছিল| তাইপিং সমাজে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পায়, তাই ভূসম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে এক ধরনের আদি সাম্যবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, যা তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার বিপরীত ছিল|
বিদ্রোহীরা 1853 সালে স্বর্গীয় ভূমিব্যবস্থা নামে একটি দলিল প্রচার করে, যাতে বিদ্রোহীদের ভূমিব্যবস্থা একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়| ভূমিহীন কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মধ্যে ভূমি বন্টন করা হতো| কোন পরিবারকে জমির মালিকানা দেওয়া হতো না, কেবল ভূমি ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়| নারী-পুরুষ সবাই সম পরিমাণ জমি পেত| সেজন্য তাইপিং বিদ্রোহের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে অনেক কৃষক এই আন্দোলনের শরিক হয়| তাইপিং বিদ্রোহীদের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরবর্তীকালে চীনাবাসীদের কাছে সু-মহান আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়| আধুনিক চীনের জনক সান-ইয়াৎ-সেনের উপরে এই বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না|
সুতরাং তাইপিং বিদ্রোহকে ধর্ম নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্যবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি বিদ্রোহ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে|
.
তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই যে কথাটি মনে হয় সেটি হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ে তাইপিং আন্দোলন ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন| বৌদ্ধ, তাও এবং কনফুসীয় ধর্ম বিরোধী এই আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মাধ্যমে সমস্ত মানুষকে চীনা রূপে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা এবং একনায়কতন্ত্রের অধীন দেশে একটি ধর্মরাজ্য স্থাপন করা| আন্দোলন চলাকালীন তাইপিংরা পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করেন| বহু বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়|
চীনের মানচিত্র |
চীনের সাম্যবাদী ঐতিহাসিকরা তাইপিং আন্দোলনকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কৃষি বিপ্লব রূপে গণ্য করেছিল| হুং ছিলেন কৃষক পরিবার ভুক্ত এবং তার অনুগামীদের মধ্যে কৃষকরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ| বিদ্রোহীরা অত্যাচারী জমিদার ও জনস্বার্থ বিরোধী রাজপুরুষদের নিহত করেছিল| জমির মালিক থেকে আরম্ভ করে ঋণপত্র ও মহাজনের কাছে রক্ষিত যাবতীয় নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল| এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তাইপিং বিদ্রোহ সামন্ততন্ত্রের বিরোধী সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করেছিল| গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা তাইপিং এর আন্দোলনকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে প্রথম কৃষি বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন|
তবে তাইপিং বিদ্রোহকে কেবলমাত্র কৃষক বিদ্রোহ রূপে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত নয়| তাইপিং বিদ্রোহের মাঞ্চু বিরোধী ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ| তাইপিং বিদ্রোহের তিন প্রধান নেতা যে মাঞ্চু বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, সেই জেহাদ ছিল জাতীয়তাবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত| এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল, চীনকে মাঞ্চুদের অপশাসন থেকে মুক্ত করা| আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের শ্লোগান ছিল, চিং বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিং বংশকে ফিরিয়ে আনা|
আবার কেউ কেউ তাইপিং বিদ্রোহকে সাম্যবাদী আন্দোলনের পূর্বাভাস বলে অভিহিত করেছেন| বিদ্রোহীরা নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী ছিল| তাইপিং সমাজে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পায়, তাই ভূসম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে এক ধরনের আদি সাম্যবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, যা তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার বিপরীত ছিল|
বিদ্রোহীরা 1853 সালে স্বর্গীয় ভূমিব্যবস্থা নামে একটি দলিল প্রচার করে, যাতে বিদ্রোহীদের ভূমিব্যবস্থা একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়| ভূমিহীন কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মধ্যে ভূমি বন্টন করা হতো| কোন পরিবারকে জমির মালিকানা দেওয়া হতো না, কেবল ভূমি ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়| নারী-পুরুষ সবাই সম পরিমাণ জমি পেত| সেজন্য তাইপিং বিদ্রোহের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে অনেক কৃষক এই আন্দোলনের শরিক হয়| তাইপিং বিদ্রোহীদের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরবর্তীকালে চীনাবাসীদের কাছে সু-মহান আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়| আধুনিক চীনের জনক সান-ইয়াৎ-সেনের উপরে এই বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না|
সুতরাং তাইপিং বিদ্রোহকে ধর্ম নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্যবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি বিদ্রোহ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে|
তথ্যসূত্র
- অমিত ভট্টাচার্য, "চীনের রূপান্তরের ইতিহাস 1840-1969"
- Jonathan Fenby, "The Penguin History of Modern China".
সম্পর্কিত বিষয়
- প্রথম আফিম যুদ্ধ (আরও পড়ুন)
- তাওবাদ কি (আরো পড়ুন)
- কনফুসিয়ানিজম কি (আরো পড়ুন)
- হুং সিউ চুয়ান (আরও পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................