প্রায় পাঁচশত বছর ধরে পাল ও সেন রাজবংশের রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়| এই দুটি রাজবংশের রাজত্বকালে ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা সহ সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালি মনীষারা এক নজিরবিহীন স্ফুরণ ঘটেছিল|
পাল আমলে বাঙালি তার মাতৃভাষার সম্মান পায়| মাগধী প্রাকৃতের গৌর-বঙ্গীয় রূপের অপভ্রংশ ভাষার মিশ্রণের ফলে এই ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল| এই ভাষাকে বাংলা ভাষা না বললেও প্রায় বাংলা ভাষা বলা যায়| সহজযানী বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকগণ প্রথমে এই প্রায় বাংলা ভাষায় তাদের পদ রচনা করেছিলেন| এগুলি চর্যাপদ নামে পরিচিত|
1907 খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত হরপ্পাশাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন| অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এগুলি 950-1200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল| এই চর্যাপদগুলিকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন বলা যায়|
1907 খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত হরপ্পাশাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন| অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এগুলি 950-1200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল| এই চর্যাপদগুলিকে প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন বলা যায়|
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ |
পাল ও সেন যুগে সাহিত্য চর্চার প্রধান মাধ্যম সংস্কৃত ভাষা| সংস্কৃত সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই সময় বাংলা সর্বভারতীয় বৈর্দভী রীতিকে অস্বীকার করে অলংকার বহুল গৌড়ীয় রীতির উদ্ভব হয়| দশম শতকের কবি রাজ শেখর তার "কাব্য মীমাংসা" গ্রন্থে গৌড়ীয় রীতির উল্লেখ করেছেন| বস্তুত বঙ্গদেশে যেসব বৌদ্ধ ও সাহিত্য রচিত হয়েছিল, সেগুলি মূলত গৌড়ীয় রীতিকে অবলম্বন করে লেখা হয|
সংস্কৃত ভাষায় রচিত পাল আমলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাব্য হল- সন্ধ্যাকর নন্দীর "রামচরিত"| এই কাব্যটি দ্ব্যর্থবোধক| একদিক থেকে দেখলে এতে রামচন্দ্রের কাহিনী এবং উপর দিক থেকে এতে পাল রাজ রামপাল কর্তৃক কৈর্বত বিদ্রোহ দমন এবং বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে মদন পাল পর্যন্ত পাল শাসনের ইতিকাহিনী বর্ণিত হয়েছে| রামচরিত ছাড়াও ক্ষেমীশ্বর রচিত "চন্ড কৌশিক নাটক", নীতিবর্মা রচিত অলংকার বহুল কাব্য "কীচক বধ" এবং "কবীন্দ্র বচন সমুচ্চয়" নামক কবিতার সংকলন পুঁথিটি উল্লেখ্য দাবি রাখে| কবীন্দ্র বচন সমুচ্চয় কে সংকলন করেছিলেন, তা জানা যায় না| এতে 111 জন কবির মোট 512 টি শ্লোক সংকলিত হয়েছে|
পাল আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, দর্শন ও সংস্কার বিষয়ক বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচিত হয়েছিল| এই যুগে হুগলি জেলার বরশুট গ্রামের কবি শ্রীধর ভট্ট "ন্যায় কন্দলী" নামে বৈশেষিক সূত্রের উপর একটি টীকা রচনা করেন| এই যুগের বিখ্যাত শাস্ত্রকার ছিলেন- ভবদেব ভট্ট| তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রায়শ্চিত্ত প্রকরন, ব্যবহার তিলক, দশকর্ম পদ্ধতি ইত্যাদি|
শরীর ও চিকিৎসা শাস্ত্র সংক্রান্ত কয়েকটি গ্রন্থ পাল যুগে রচিত হয়| চক্রপাণি দত্ত "চিকিৎসা সংগ্রহ" নামে বিখ্যাত চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন| এছাড়া তিনি চরক ও সুশ্রুত উপর টীকা গ্রন্থ "আয়ুর্বেদ দীপিকা" ও "ভানুমতী" রচনা করেন| এছাড়া এই যুগে সুরেশ্বর ও বঙ্গসেন নামে দুজন বিখ্যাত চিকিৎসক জন্মগ্রহণ করেছিলেন| সুরেশ্বর ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ|
পাল যুগে বৌদ্ধ দর্শন ও ধর্ম শাস্ত্রের চর্চার অগ্রগতি হয়| মহা পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন পাল যুগের বিখ্যাত পন্ডিত| তিব্বতি ঐতিহ্য অনুসারে তিনি প্রায় 175 গ্রন্থ রচনা করেন| এগুলি অধিকাংশই ছিল বজ্রযান বিষয়ক| অতীশ দীপঙ্কর ছাড়াও পাল যুগের বিখ্যাত পণ্ডিতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমল শীল, রাহুল ভদ্র, কল্যাণ রক্ষিত প্রমূখ| বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য জেতারি নামে দুজন লেখকের নাম জানা যায়| একজন মহাজেতারি অন্যজনের কনিষ্ঠ জেতারি, মহাজেতারি অতীশ দীপঙ্করের ধর্মগুরু ছিলেন|
পাল ও সেন যুগের সাহিত্য
সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেন শাসনকাল ছিল সুবর্ণ যুগ| সেন রাজারা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, অনেকে সাহিত্য সৃষ্টিও করেন| হিন্দু শাস্ত্রে সুপন্ডিত সেন রাজ বল্লাল সেন হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত "দানসাগর" ও "অদ্ভুতসাগর" নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন| লক্ষণ সেন নিজে একজন সুকবি ছিলেন| ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব- গ্রন্থের রচয়িতা হলায়ুধ লক্ষন সেনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন| গীতগোবিন্দ রচয়িতা জয়দেব ছিলেন লক্ষণ সেনের সভাকবি|
গীতগোবিন্দ ছাড়াও উমাপতিধর, গোবর্ধন, শরণ, দৈয়ী প্রমুখ বিগদ্ধ পন্ডিততেরা লক্ষন সেনের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন| বিশিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞ জীমূত সম্ভবত সেন যুগের মানুষ ছিলেন| তাঁর রচিত "দায় ভাগ" হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত একটি বিখ্যাত গ্রন্থ|
পাল ও সেন যুগের ভাস্কর্য স্থাপত্য, ভাস্কর্য
স্থাপত্য
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ক্ষেত্রে পাল ও সেন যুগের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল| স্তুপ, বিহার ও মন্দির ধ্বংসাবশেষ থেকে পাল ও সেন যুগের স্থাপত্য কলার পরিচয় পাওয়া যায়| পাল যুগে যে স্তুপগুলি নির্মিত হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিল "নিবেদক স্তুপ", অর্থাৎ এইগুলি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল|এই স্তুপগুলি ছিল নিম্নমানের এবং অধিকাংশ ইট বা পাথরের তৈরি| তবে পাল স্থাপত্য শিল্পে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে ওদন্তপুর ও পাহাড়পুরের বিহারগুলিতে| বিশেষ করে পাহাড়পুরের সোমপুরী মহাবিহারের ভগ্নাবশেষ এর গঠন সই সকলের প্রশংসা অর্জন করেছে|
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় পাহাড়পুরকে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের বিস্ময়কর বলে বর্ণনা করেছেন| তিব্বতে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলার স্থাপত্য কৌশলের অনুকরণ দেখতে পাওয়া যায়|
ভাস্কর্য
পাল যুগের ভাস্কর্য শিল্প গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য নীতির একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হয়ে নিজ ধারায় প্রবাহিত হয়| পাহাড়পুর ছিল পাল ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্র| পাহাড়পুরের মহাবিহারের গায়ে খোদাই করা মূর্তি গুলি পাল যুগের উন্নত ভাস্কর্যের পরিচয় বহন করে| পাহাড়পুর ছাড়াও কুমিল্লার ময়নামতি ও লালমাই পাহাড়ে পাল ভাস্কর্যের নিদর্শন নিদর্শন পাওয়া গেছে| পাল যুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যকর ছিলেন ধীমান ও বীতপাল| ব্রঞ্চ পাথর খোদাই ও চিত্র আঁকার কাজে এদের খুবই খ্যাতি ছিল|প্রধানত মানুষের মূর্তি নির্মাণই ছিল পাল ভাস্কর্যের প্রধান বিষয়বস্তু| এগুলিতে আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়| মহীপালের রাজত্বকালে তৈরি "বিষ্ণু মূর্তি", গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকালে নির্মিত "সূর্য মূর্তি" এবং তৃতীয় গোপালের আমলে তৈরি "সোদাশিল্প" উন্নত পাল ভাস্কর্যের উদাহরণ|
সেন যুগের শিল্পকলা
সেন যুগের শিল্পকলায় জাগতিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ দেখা দেখা যায় এবং তার সঙ্গে দেখা যায় আনন্দ সম্ভক| সেন যুগে শিল্প নিদর্শন বেশি পাওয়া যায়নি, তবে লক্ষন সেনের রাজত্বকালে চাকায় প্রাপ্ত চন্ডী মূর্তি চিত্র যুগের অন্যতম শিল্প নিদর্শনের প্রতীক|
বিজয় সেনের দোয়া পাড়া প্রস্তুতিতে একাধিক শিল্পীর নাম জানা যায়, যেমন- শৃলপানি, সোমেশ্বর, বিমলদাস, মহীধর, কর্নধর, তথাগত সার প্রমুখ| পাল যুগের শিল্পকলায় যেখানে আড়ম্বরহীন জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে, সেখানে সেন যুগের শিল্পকলায় উপভোগ ও বিলাসী প্রাধান্য পেয়েছে|
পাল যুগের চিত্রকলা
ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে পাল যুগের চিত্রকলা এক বিশেষ স্থান রয়েছে| তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারানাথ এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ধীমান ও বীতপাল উভয়ই তক্ষণশিল্পে, ধাবত্ব, মূর্তি শিল্পে ও চিত্রশিল্পের এক বিশিষ্ট বিশিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন|
নালন্দার একটি মন্দিরের দেওয়ালের গাত্রে পাল যুগের চিত্রকলা কিছু নিদর্শন আজও বিদ্যমান| তবে পাল যুগের চিত্রকলা প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় সেন যুগের চিত্র সংযুক্ত পুঁথিতে| এগুলি হল- অষ্ট্রোসাহস্রিৌয়া-প্রজ্ঞাপারমিতা, পঞ্চ, বিংশতি-সাহস্রিকা পজ্ঞাপারমিতা, পঞ্চরক্ষা ইত্যাদি|
ধর্মীয় জীবন
পাল যুগ
পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন| এই সময় ভারতের অন্যান্য স্থানে বৌদ্ধ ধর্ম দুর্বল হয়ে পড়ে| একমাত্র বাংলায় এই ধর্ম পাল রাজাদের আশ্রয় নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিলেন| এই যুগের বৌদ্ধ ধর্ম মূল বৌদ্ধ ধর্ম থেকে পৃথক ছিল| বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান মতবাদ এই সময় বজ্রযান ও তন্ত্রযান প্রভৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করে এগুলি সহজযান বা সহজিয়া ধর্ম নামে পরিচিত| পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মে হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তারা সহিষ্ণু ছিল|সেন যুগ
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের আমলে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং বৌদ্ধ ধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ে| এই যুগের একধারে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও অন্যদিকে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম দুই জনপ্রিয় হয়ে উঠে| সূর্য, অগ্নি, ইন ইন্দ্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতার পূজা প্রচলন বৃদ্ধি পায়| পাশাপাশি শিব, দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে|সরস্বতী |
শিব |
দুর্গা |
গণেশ |
পাল ও সেন যুগে যুগে শিক্ষার অগ্রগতি
পাল ও সেন রাজারা বিদ্যা ও বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন| পাল রাজাদের উৎসাহে বিক্রমশিলা, ওদন্তপুর, দেবীকোট ও পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার ও শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল| এদের মধ্যে বিক্রমশিলা মহাবিহার ছিল জগৎ বিখ্যাত| অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন মহাবিহার এর প্রধান আচার্য| দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র, গণিত ইত্যাদি বিষয় থেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে সমবেত হতেন| সেন আমলে নবদ্বীপ সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল|মূল্যায়ন
মোটকথা পাল রাজারা মাৎস্যন্যায় এর অবসান ঘটিয়ে বাংলায় যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার ফলে বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলার সর্বত্র ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না| তাই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মজুমদার বলেছেন, পাল সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির নতুন জাতীয় জীবনের সূত্রপাত হয়| পরবর্তীতে সেন যুগেও তা অব্যাহত থাকে|তথ্যসূত্র
- Sudipa Bandyopadhyay, "Architectural Motifs in Early Mediaeval Art of Eastern India: (Pala-Sena Period)".
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
সম্পর্কিত বিষয়
- মধ্যপন্থা (আরো পড়ুন)
- জৈন ধর্মের বৈশিষ্ট্য (আরো পড়ুন)
- প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (আরো পড়ুন)
Author of this post
Serina Khatun About- তিনি বর্তমানে একজন ইতিহাসের ছাত্রী Read more- (click here) |
.................................