ধর্মপাল ও দেবপাল এর রাজনৈতিক সাফল্য

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশত বছর ধরে বাংলাদেশের অরাজকতা, অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণ চলতে থাকে, বাংলার ইতিহাসে এই যুগকে মাৎস্যন্যায় যুগ বলা হয়| 

খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, এই বিশৃঙ্খলার যুগের অবসান কল্পে প্রকৃতি পুঞ্জ গোপালকে গৌড়ের রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন|

গোপালের মৃত্যুর পর আনুমানিক 770 খ্রিস্টাব্দে তার সুযোগ্য পুত্র ধর্মপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন| তিনি ছিলেন সুনিপুণ যোদ্ধা ও কূটনীতিজ্ঞ, তিনি বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্রপাল সাম্রাজ্যকে একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সচেষ্ট ছিলেন|

ধর্মপাল-ও-দেবপাল-এর-রাজনৈতিক-সাফল্য




ধর্মপাল 

ধর্মপালের দীর্ঘ 40 বছর রাজত্বকালের(770-810 খ্রিস্টাব্দ) প্রধান ঘটনায় ছিল উত্তর ভারতের সাম্রাজ্যকে বিস্তারকে কেন্দ্র করে পশ্চিম ভারতের গুর্জ্জর প্রতিহার বংশ এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা| ধর্মপালও এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন| এইভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকা বিশেষ করে হর্ষবর্ধনের স্মৃতি বিজলিত কৌনজ দখলকে কেন্দ্র বাংলার পাল বংশ পশ্চিম ভারতের প্রতিহার বংশ এবং দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে এক দীর্ঘকালীন সংঘর্ষের সূচনা শুরু হয়, যা ইতিহাসে ত্রিশক্তি সংগ্রাম নামে পরিচিত|

ধর্মপাল সিংহাসনে বসেই মগধ, বারানসী জয় করে কনৌজ দিকে অগ্রসর হতে থাকলে গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে প্রতিহার রাজ বৎসরাজ তাকে বাধা দেয়| এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন| কিন্তু বৎসরাজ জয়ের ফল ভোগ করার পূর্বেই তৃতীয় শক্তি রূপে রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের আবির্ভাব ঘটে| ধ্রুবের কাছে পরাজিত হয়ে বৎসরাজ রাজপুতানার মরু অঞ্চলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন| এরপর ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন| গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই সংঘর্ষ ঘটে| ধর্মপাল এই যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের কাছে পরাজিত হন|অচিরেই রাষ্ট্রকূট অধিপতি ধ্রুবেও দাক্ষিণাত্য ফিরে যেতে বাধ্য হন|

অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, রাষ্ট্রকূট অভিযানের ফলে ধর্মপালের ক্ষতির তুলনায় লাভই হয়েছিল বেশি| প্রতিহার রাজ্যের পরাজয় ও ধ্রুবর নিজ রাজ্য প্রত্যাবর্তনের ফলে উত্তর ভারতে যে শক্তি শূন্যতার সৃষ্টি হয় ধর্মপাল তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহন করেন এবং পুনরায় ক্ষমতা বিস্তারে অগ্রসর হন| নারায়ন পালের ভাগলপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করেন এবং কৌনজের সিংহাসনের পূর্ববর্তী রাজা ইন্দ্রযুধকে বিতাড়িত করে নিজ মনোনীত প্রতিনিধি চক্রাযুধকে সিংহাসনে বসান| মুঙ্গের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল কনৌজ অতিক্রম করে বোদার গোর্কন দখল করেছিলেন|

খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, আর্যাবর্তের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে জয় করার পর ধর্মপাল কৌনজের দরবারে অনুষ্ঠান করেন| সেই দরবারে উত্তর ভারতের বহু রাজা উপস্থিত হয়ে ধর্মপালের প্রতি বশ্যতা জ্ঞাপন করেন| খালিমপুর তাম্রশাসনে এই সামন্ত রাজাদের রাজ্যের যে নামগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি হল- গান্ধার(পশ্চিম পাঞ্জাব), অবন্তী(রাজপুতানা), পুরু(পূর্ব পাঞ্জাব) প্রভৃতি|

এই সব রাজ্যের অবস্থান থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ধর্মপাল প্রায় সমগ্র রাজার্বতের অদৃশ্য ছিল| এই বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে বিহার ও বাংলাদেশে ছিল তার প্রত্যক্ষ শাসনের| কনৌজ ছিল তার অধীন, কিন্তু প্রত্যক্ষ শাসন বহির্ভূত একটি অঞ্চল| তার বাইরে পাঞ্জাব পর্যন্ত ও মালব রাজপুতনা পর্যন্ত তার সামন্ত রাজ্য ছিল| এই সামন্ত রাজারা তার প্রতি অনুগত জানাতেন|

তবে ধর্মপাল নিশ্চিন্তে বিশাল সাম্রাজ্যে ভোগ করতে পারেননি| বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্টের নেতৃত্বে প্রতিহার শক্তির আবার জেগে উঠে এবং দ্বিতীয় নাগভট্ট সিন্ধু, বির্দভ, অন্দ্র প্রভৃতি রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে কনৌজ আক্রমণ করেন| চক্রাযুধ ধর্মপালের শরণাপন্ন হলে ধর্মপাল দ্বিতীয় নাগভট্টের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন| প্রতিহার রাজ ভোজের গোয়ালিয়র লিপি থেকে জানা যায় যে, এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হয়েছিলেন| যুদ্ধটি সম্ভবত মুঙ্গিরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল|

তবে নাগভট্টের এই সাফল্য ছিল সামরিক| পরাজিত ধর্মপাল আত্মরক্ষার্থে ও সম্মান পুনরুদ্ধার জন্য রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য প্রার্থী হন| তৃতীয় গোবিন্দ বিশাল বাহিনী নিয়ে নাগভট্টকে পরাজিত করে| রাষ্ট্রকূট রাজাদের প্রস্তুতি থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল ও চক্রাযুধ উভয়ই স্বেচ্ছায় তৃতীয় গোবিন্দের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন| তবে নিজ রাজ্য গোলযোগ দেখা দিলে তৃতীয় গোবিন্দ পিতার মতোই দাক্ষিণাত্য প্রত্যাবর্তন করেন| ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে, এই সুযোগ নিয়ে ধর্মপাল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কৌনজ তথা উত্তর ভারতে নিজ আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন|




দেবপাল

ধর্মপালের পর বঙ্গদেশের রাজা হন তার সুযোগ্য পুত্র দেবপাল| দেবপালের আমলেই পাল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে| সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাকে একাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল| দাক্ষিণাত্যের তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট রাজ্য আন্তরিক গোলযোগ দেখা দেয়| রাষ্ট্রকূট রাজ প্রথম অমোঘ বর্ষ ব্যক্তিগতভাবে দুর্বল ছিলেন|

প্রতিহার রাজ নাগভট্টের মৃত্যুর পর সতীকামী রামভদ্র রাজা হয়েছিলেন| এছাড়া দেবপালের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ পশ্চাতে আদর্শগত অনুপ্রেরণাও ছিল এবং এই আদর্শ রূপায়নের সাহায্য করেছিল তার প্রধানমন্ত্রী দর্মপানি এবং পৌত্র কেদার মিশ্র|

দেবপালের রাজত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নারায়ণ পালের বাদল স্তম্ভ লেখ| বাদল স্তম্ভ লেখতে দাবি করা হয়েছে যে, দর্ভপালের কূটনীতির ফলে দেবপাল উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিনে বিন্ধ্য পর্বত এবং পূর্ব সাগর থেকে পশ্চিম সাগর বিস্তৃত সমগ্র ভারত থেকে কর আদায় করতে পেরেছিলেন| আবার ঐতিহাসিক আব্দুল মৌমিন চৌধুরি বাদল স্তম্ভ লেখর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না|

তবে বাদল স্তম্ভ লেখর দাবি একেবারে মিথ্যা বলে মনে হয় না| হিমালয়ের সানু দেশে হুনরাষ্ট এবং প্রাগজ্যোতিষ, কম্বোজ, উৎকল প্রভৃতি রাজ্য ধর্মপালের সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত সীমায় অবস্থিত ছিল| তাই দেবপালের পক্ষে এসব রাজ্য জয়ের প্রয়াস স্বাভাবিক বলেই মনে হয়| শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরে দেবপালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল| দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শৈলেন্দ বংশীয় রাজা বল পুত্রদেব নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করে দেবপালের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন|



মূল্যায়ন 

অর্ধশতাব্দী কাল পর্যন্ত ধর্মপাল ও দেবপাল উত্তর ভারতের এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন|অনেকে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের উত্তর ভারতের সাম্রাজ্যকে উত্তর ভারতের শেষ সাম্রাজ্য বলে মনে করেন| কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের চেয়েও পাল সাম্রাজ্য অধিক বিস্তৃত ও অধিকার স্থায়ী ছিল|

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে, আর্যাবর্তের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলায় ধর্মপাল ও দেবপালের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা| বাঙালি জাতির ইতিহাসে এরূপ শক্তিও সমৃদ্ধির পরিচয় এর পূর্বে বা পরে আর কখনো পাওয়া যায়নি|




তথ্যসূত্র

  1. Sen, "Ancient Indian History and Civilization".
  2. Sudipa Bandyopadhyay, "Architectural Motifs in Early Mediaeval Art of Eastern India: (Pala-Sena Period)".
  3. Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. পাল ও সেন যুগে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন (আরো পড়ুন)
  2. পাল যুগের চিত্রকলা (আরো পড়ুন)
  3. বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের কারণ ও ফলাফল  (আরো পড়ুন)

Author of this post

Name- Elora Saha
About- বর্তমানে তিনি একজন গৃহবধূ
Read more- (click here)

                        .................................


নবীনতর পূর্বতন
👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    
  
  👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
  


  

   

    👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
  


  

   
  
  
    👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️

    👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 


    
  

  

টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


 


 





👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️



👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

👉ক্লিক করুন 🌐