সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী কিনা সেই সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ আছে। আর. পি. ত্রিপাঠী, ঈশ্বরী প্রসাদ, এ. এল. শ্রীবাস্তব প্রমূখ মনে করেন, তুর্কি আফগান যুগে ভারত রাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রয়ী।
ঈশ্বরী প্রসাদ এর মতে, সুলতানদের সীমাহীন ক্ষমতা অবশ্যই ছিল, তবে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় বিচারে সুলতান ছিল সর্বসেবা। কিন্তু তারাও শরীয়তের নির্দেশ লংঘন করতে পারতেন না। শরীয়ত বা ধর্মশাস্ত্রের বিধান ছিল সুলতানি আমলে নীতি-নির্ধারণের মাধ্যম।
প্রকৃতপক্ষে সুলতানি শাসন ব্যবস্থায় কুরআন বা শরীয়ত আইন ছিল সর্বোচ্চ বা মৌলিক। শরীয়তী আইনে ব্যাখ্যাকার হিসাবে সুলতানি আমলের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উলেমারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। উলেমারা মূল ইসলামী আইন অর্থাৎ শরীয়তে যা ব্যাখ্যা করতেন, সুলতানরা তা মান্য করতেন। রাষ্ট্রের আইন-বিধি রচনার সময় সুলতানরা উলামাদের পরামর্শ নিতেন। আলাউদ্দিন খলজির পূর্ববর্তী প্রায় সব সুলতান উলেমাদের সম্মতি ছাড়া কোন কাজ করতে ভিতি বোধ করতেন।
ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন যে, সুলতানি আমলের কর ব্যবস্থা ও শরীয়ত অনুসারে প্রযুক্ত ছিল। অ-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার কাজে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সরাসরি ব্যবহার করা হতো। অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হতো। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছাড়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই কর বৈষম্য সম্ভব ছিল না।
ইসলামী রাষ্ট্র চিন্তায় বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্র কেবলমাত্র এক সার্বভৌম শাসকের অধীন। আদিতে তিনি পয়গম্বর এবং তার তিরোধানের/মারা পর খলিফা সকল ইসলামীয় রাষ্ট্রে অধিপতি নিযুক্ত হন। ইসলামের কোন দ্বিতীয় সার্বভৌম শাসক নেই। ইসলামীয় রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা সার্বভৌম ক্ষমতার দাবী করতে পারেন না। বাস্তব ক্ষেত্রে দিল্লির সুলতানরাও নিজেদেরকে খলিফার ভৃত্য বলে মনে করতেন।
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সুলতানি রাষ্ট্র কি নিঃসন্দেহে ধর্মাশ্রয়ী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সুলতানি রাষ্ট্র আদৌও ধর্মাশ্রয়ী ছিল না।
প্রসঙ্গত ইলতুৎমিশের আমলে একটি ঘটনা স্মরণীয়- একবার উলেমারা দলবদ্ধভাবে সুলতানের কাছে গিয়ে ইসলামী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রতুত্তরে সুলতানের উজির(প্রধানমন্ত্রী) উলেমাদের জানিয়ে দেন যে, "এই ব্যবস্থা বাস্তব সম্মত নয় এবং রাজনীতির সম্মত নয়। কারণ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ, যেন ভাতের থালার লবণের মত।
কুরআন |
ইসলাম ধর্মে ব্যক্তি |
প্রকৃতপক্ষে সুলতানি শাসন ব্যবস্থায় কুরআন বা শরীয়ত আইন ছিল সর্বোচ্চ বা মৌলিক। শরীয়তী আইনে ব্যাখ্যাকার হিসাবে সুলতানি আমলের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উলেমারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। উলেমারা মূল ইসলামী আইন অর্থাৎ শরীয়তে যা ব্যাখ্যা করতেন, সুলতানরা তা মান্য করতেন। রাষ্ট্রের আইন-বিধি রচনার সময় সুলতানরা উলামাদের পরামর্শ নিতেন। আলাউদ্দিন খলজির পূর্ববর্তী প্রায় সব সুলতান উলেমাদের সম্মতি ছাড়া কোন কাজ করতে ভিতি বোধ করতেন।
ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন যে, সুলতানি আমলের কর ব্যবস্থা ও শরীয়ত অনুসারে প্রযুক্ত ছিল। অ-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার কাজে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সরাসরি ব্যবহার করা হতো। অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হতো। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছাড়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই কর বৈষম্য সম্ভব ছিল না।
ইসলামী রাষ্ট্র চিন্তায় বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্র কেবলমাত্র এক সার্বভৌম শাসকের অধীন। আদিতে তিনি পয়গম্বর এবং তার তিরোধানের/মারা পর খলিফা সকল ইসলামীয় রাষ্ট্রে অধিপতি নিযুক্ত হন। ইসলামের কোন দ্বিতীয় সার্বভৌম শাসক নেই। ইসলামীয় রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা সার্বভৌম ক্ষমতার দাবী করতে পারেন না। বাস্তব ক্ষেত্রে দিল্লির সুলতানরাও নিজেদেরকে খলিফার ভৃত্য বলে মনে করতেন।
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সুলতানি রাষ্ট্র কি নিঃসন্দেহে ধর্মাশ্রয়ী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সুলতানি রাষ্ট্র আদৌও ধর্মাশ্রয়ী ছিল না।
প্রথমত
সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে উলামাদের কর্তৃত্ব সবসময় স্বীকৃত হতো না। সুলতানদের ইচ্ছানুসারে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু পরামর্শদান এবং বিচার বিভাগের কিছু উচ্চপদ লাভ করেই এরা সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হতেন। অনেক সময় রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সুলতানগণ উলামাদের দিয়ে শরীয়তের ব্যাখ্যাকে পরিবর্তন করে নিতেন।প্রসঙ্গত ইলতুৎমিশের আমলে একটি ঘটনা স্মরণীয়- একবার উলেমারা দলবদ্ধভাবে সুলতানের কাছে গিয়ে ইসলামী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রতুত্তরে সুলতানের উজির(প্রধানমন্ত্রী) উলেমাদের জানিয়ে দেন যে, "এই ব্যবস্থা বাস্তব সম্মত নয় এবং রাজনীতির সম্মত নয়। কারণ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ, যেন ভাতের থালার লবণের মত।
দ্বিতীয়ত
খলিফাদের প্রতি দিল্লির সুলতানদের আনুগত্য ছিল বাহ্যিক। সুলতানগণ সিংহাসনে তাদের ক্ষমতাকে দৃঢ় করার জন্য এবং মুসলিম অভিজাতদের সাংবিধানিক আগ্রাসন থেকে সুলতানি সিংহাসনকে সুরক্ষিত করার জন্যই খলিফার ফরমানকে উচ্চস্থান দিতেন। এই আনুগত্য ছিল উপযোগবাদী। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আন্তরিক ভক্তি থেকে খলিফার প্রতি এই আনুগত্য দেওয়া হয়নি। সুলতানি সিংহাসনের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যই খলিফার ফরমানকে ব্যবহার করা হতো।তৃতীয়ত
সুলতানি আমলে শরীয়তের ছোট-খাটো বহু নির্দেশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভঙ্গ করা হতো, যেমন-- ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় মুসলমানদের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক ছাড়া অন্যান্য সুলতানদের আমলে শাস্তি হিসেবে মুসলমানদেরও প্রাণদণ্ড দেওয়া হতো।
- শরীয়তের বিধানে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ, কিন্তু সুলতানি আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে সুদ গ্রহণ সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল।
- সর্বোপরি সুলতানি আমলে ব্রাহ্মণ, স্ত্রীলোক, শিশুদের জিজিয়া কর প্রদান থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল।
সেইজন্য ড. হাবিব, ড. মুজিব, ড. কুরেশী, ড. আশরাফ ও সতীশচন্দ্র প্রমূখ ঐতিহাসিকেরা সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলে মনে করেন না।
মূল্যায়ন
সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মত হলো যে, এটি ছিল সামরিক ও অভিজাত তান্ত্রিক। ধর্ম, দর্শন বা প্রজা কল্যাণ কোন কিছুই নির্দিষ্ট রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে গৃহীত হয়নি। আসলে সুলতানি আমলে রাষ্ট্র ছিল সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্টিত এবং অভিজাত গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন। সুলতানের ব্যক্তিগত সামরিক দক্ষতার উপর নির্ভর করত তার স্থায়িত্ব।
তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী, "মধ্যকালীন ভারত"
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India"
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century"
সম্পর্কিত বিষয়
- সুফিবাদ (আরো পড়ুন)
- গুরু নানক কে ছিলেন (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................