বাবর ছিলেন একজন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। পিতৃ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং আত্মীয়বর্গ দ্বারা প্রতারিত হয়ে তিনি ভারতের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। দিল্লির লোদী সুলতানরা দুর্বল হলেও আফগান সর্দাররা এবং রাজপুতরা বিনা যুদ্ধে বাবরকে রাজ্য ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। তাই বাবরকে একাধিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ, ঘর্ঘরার যুদ্ধে একে একে সুলতান ইব্রাহিম লোদী, রাজপুত ও আফগানদের পরাজিত করে তিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন।
একজন সৈনিক ও দক্ষ সমর নায়কের সমস্ত গুণাবলী বাবরের মধ্যে সমন্বিত ছিল। একজন সুচতুর সমর নায়ক ও দরদী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তিনি তার সেনাবাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য, মানবিকতা ও সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রতিটি দিক সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী কখনো কঠোরতা, কখনো আবেগ, কখনো বাস্তব চেতনা দ্বারা বাবর তার অনুগামীদের সক্রিয়তা বজায় রাখতে তৎপর ছিলেন। বিদেশের মাটিতে পরপর তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে মুঘল বাহিনীর সাফল্যের মূল কৃতিত্ব বাবরের প্রাপ্য। প্রতিপক্ষের যুদ্ধের কৌশল বা শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। তা সত্ত্বেও মুঘল বাহিনী বিজয় হয়েছে। এই জয়ে তার সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে সেনাদের প্রতিভা ও দক্ষতার পুনঃ বহিঃপ্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটানোর কৃতিত্ব অবশ্যই বাবরের প্রাপ্য।
মাত্র 48 বছর বয়সে যখন তার দেহাবসান ঘটে, তখন তার রাজ্যসীমা প্রসারিত ছিল বাদাখশান থেকে বাংলা পর্যন্ত এবং অক্ষ নদী থেকে গঙ্গা নদীর তীর পর্যন্ত। তার রাজ্যসীমা তুরস্কের সুলতান কিংবা পারস্য শাহ এর রাজ্য সমতুল্য ছিল।
তবে যোদ্ধা হিসেবে বাবর যতটা সফল ছিলেন, প্রশাসক হিসাবে ততটা ছিলেন না। বাবরের যুদ্ধ জয় ছিল একটি সামরিক ঘটনা মাত্র। রাশব্রুক উইলিয়াম বলেছেন যে, বাবর তার পুত্রের জন্য যে রাজতন্ত্র উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান, তা কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে কার্যকরী ছিল, শান্তির সময় তা ছিল দুর্বল, কাঠামো হীন এবং মেরুদণ্ডহীন।
আবার ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন, বাবর ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি ও সাহিত্যিক, কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে তার কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য ছিল না।
বাবর তার বিজীত রাজ্য কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। জনৈক ঐতিহাসিক এর মতে, বাবর কেবলমাত্র সামরিক জয় করেন। বিজিত রাজ্য একই প্রকার আইন ছিল না, প্রতি গ্রাম ও অঞ্চল স্থানীয় প্রথা অনুসারে শাসিত হতো। বাবর তার সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন আমির ও জায়গীরদারদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এই শাসন কেন্দ্রগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করার কোন ব্যবস্থা তিনি করেননি। বাবর তার সাম্রাজের বিভিন্ন স্থানে আইন-আদালত স্থাপন করে ন্যায় বিচার করার চেষ্টা করেননি। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে দৃঢ় করার জন্য যে মজবুত রাজস্ব, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করার দরকার, বাবর তা করেননি। দিল্লি, আগ্রা ও গোয়ালিয়রের জয়ের পর এক বিরাট ধনরত্ন তার হাতে এসেছিল, কিন্তু তিনি তার সেনাদলের মধ্যেই বিতরণ করে দেন। এরফলে বাবরের রাজকোষ শূন্যই থেকে যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, হুমায়ুনের দুর্ভাগ্যের জন্য বাবরই দায়ী ছিল।
কিন্তু বাবর সম্পর্কে উপরিউক্ত মূল্যায়ন যথার্থ নয়। বাবরের কৃতিত্বকে কখনোই হেয় করা যায় না। বাবরের রাজত্বকাল ছিল মাত্র চার বছর। এই সময়কালের অধিকাংশ সময়ই তিনি যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। একের পর এক ভারতীয় শক্তি তাকে প্রতিহত ও ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তাই শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। সর্বোপরি ভারতীয়দের কাছে মুুঘলরা বিদেশি বলেই অভিহিত ছিল। তাই ভারতীয় জনসাধারণের বিভিন্ন প্রথা, আইন ও সংস্কারগুলির ভালো মন্দ না বুঝে বাবরের পক্ষে হঠাৎ কোনো প্রশাসনিক ও আইনগত সংস্কার চালু করা সম্ভব ছিল না। শেরশাহ কিংবা আকবরের মতো ভারতীয় জীবন সম্পর্কে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই সঙ্গত কারণে বাবর হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেন।
তাই ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, "রাজপুরুষ, যোদ্ধা এবং পন্ডিত হিসেবে বাবর ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের মধ্যে অন্যতম। ব্যক্তিগতভাবে বাবর গোড়া সুন্নি হলেও ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামি তার ছিল না"। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা চলে যে, বাবরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন বিচার করা উচিত ভারতে তার সাফল্যের দিকগুলি নিয়ে, ব্যর্থতা নিয়ে নয়। বাবর কি করেননি বা করতে পারেননি, তার ভিত্তিতে বাবরের রাষ্ট্র-প্রাঞ্জা বিচার করলে ভুল হবে। আমাদের দেখা উচিত বাবর কি করেছিলেন বা কি করতে চেয়েছিলেন।
মাত্র 48 বছর বয়সে যখন তার দেহাবসান ঘটে, তখন তার রাজ্যসীমা প্রসারিত ছিল বাদাখশান থেকে বাংলা পর্যন্ত এবং অক্ষ নদী থেকে গঙ্গা নদীর তীর পর্যন্ত। তার রাজ্যসীমা তুরস্কের সুলতান কিংবা পারস্য শাহ এর রাজ্য সমতুল্য ছিল।
তবে যোদ্ধা হিসেবে বাবর যতটা সফল ছিলেন, প্রশাসক হিসাবে ততটা ছিলেন না। বাবরের যুদ্ধ জয় ছিল একটি সামরিক ঘটনা মাত্র। রাশব্রুক উইলিয়াম বলেছেন যে, বাবর তার পুত্রের জন্য যে রাজতন্ত্র উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান, তা কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে কার্যকরী ছিল, শান্তির সময় তা ছিল দুর্বল, কাঠামো হীন এবং মেরুদণ্ডহীন।
আবার ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন, বাবর ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি ও সাহিত্যিক, কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে তার কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য ছিল না।
বাবর তার বিজীত রাজ্য কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। জনৈক ঐতিহাসিক এর মতে, বাবর কেবলমাত্র সামরিক জয় করেন। বিজিত রাজ্য একই প্রকার আইন ছিল না, প্রতি গ্রাম ও অঞ্চল স্থানীয় প্রথা অনুসারে শাসিত হতো। বাবর তার সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন আমির ও জায়গীরদারদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এই শাসন কেন্দ্রগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করার কোন ব্যবস্থা তিনি করেননি। বাবর তার সাম্রাজের বিভিন্ন স্থানে আইন-আদালত স্থাপন করে ন্যায় বিচার করার চেষ্টা করেননি। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে দৃঢ় করার জন্য যে মজবুত রাজস্ব, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করার দরকার, বাবর তা করেননি। দিল্লি, আগ্রা ও গোয়ালিয়রের জয়ের পর এক বিরাট ধনরত্ন তার হাতে এসেছিল, কিন্তু তিনি তার সেনাদলের মধ্যেই বিতরণ করে দেন। এরফলে বাবরের রাজকোষ শূন্যই থেকে যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, হুমায়ুনের দুর্ভাগ্যের জন্য বাবরই দায়ী ছিল।
কিন্তু বাবর সম্পর্কে উপরিউক্ত মূল্যায়ন যথার্থ নয়। বাবরের কৃতিত্বকে কখনোই হেয় করা যায় না। বাবরের রাজত্বকাল ছিল মাত্র চার বছর। এই সময়কালের অধিকাংশ সময়ই তিনি যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। একের পর এক ভারতীয় শক্তি তাকে প্রতিহত ও ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এগিয়ে এসেছে। তাই শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। সর্বোপরি ভারতীয়দের কাছে মুুঘলরা বিদেশি বলেই অভিহিত ছিল। তাই ভারতীয় জনসাধারণের বিভিন্ন প্রথা, আইন ও সংস্কারগুলির ভালো মন্দ না বুঝে বাবরের পক্ষে হঠাৎ কোনো প্রশাসনিক ও আইনগত সংস্কার চালু করা সম্ভব ছিল না। শেরশাহ কিংবা আকবরের মতো ভারতীয় জীবন সম্পর্কে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই সঙ্গত কারণে বাবর হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেন।
তাই ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, "রাজপুরুষ, যোদ্ধা এবং পন্ডিত হিসেবে বাবর ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের মধ্যে অন্যতম। ব্যক্তিগতভাবে বাবর গোড়া সুন্নি হলেও ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামি তার ছিল না"। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা চলে যে, বাবরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন বিচার করা উচিত ভারতে তার সাফল্যের দিকগুলি নিয়ে, ব্যর্থতা নিয়ে নয়। বাবর কি করেননি বা করতে পারেননি, তার ভিত্তিতে বাবরের রাষ্ট্র-প্রাঞ্জা বিচার করলে ভুল হবে। আমাদের দেখা উচিত বাবর কি করেছিলেন বা কি করতে চেয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"।
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "অষ্টাদশ শতকের মুঘল সংকট ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা"।
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"।
- Shireen Moosvi, "People, Taxation and Trade in Mughal India".
সম্পর্কিত বিষয়
- মুঘল মুদ্রা ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- মুঘল চিত্রকলা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- মুঘল ভারতের ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................