ইলিয়াস শাহী বংশের শতাধিক বছরের অধিক শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ইলিয়াস শাহের সিংহাসন আহরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাসে এক নবযুগ নবযুগের সূচনা হয়। বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়।
অধ্যাপক আব্দুল করিম এর ভাষায়, "বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে"।
দিল্লি সুলতানি প্রবল প্রতিপত্তি যুগে ইলিয়াস শাহ বাংলার দিল্লির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। এই বংশের রাজত্বকাল শতাধিক বছর তো বটেই- এর পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবরের বঙ্গবিজয় পর্যন্ত বাংলার স্বাধীন সত্ত্বা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ইলিয়াস শাহীর শাসকরা শুধু বাংলায় নয়- বিহার, আসাম, কামতা রাজ্য, উড়িষ্যা, বানারসি, চম্পরন প্রভৃতি স্থানের উপরেও বাংলার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই সময় বাংলার খ্যাতি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশে জৌনপুরের সুলতান, চীন দেশের মিউ সম্রাট এবং পারস্য ও মদিনাতে ইলিয়াস শাহীর সুলতানরা দূত পাঠিয়ে ছিলেন। অনুরূপভাবে চীন দেশের একাধিক দূত বাংলায় আসে।
বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান
বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপরেও ইলিয়াস শাহী বংশের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইলিয়াস শাহীর সুলতানরা হিন্দু-মুসলমান বঙ্গবাসীর সমন্বয়ে বাংলায় এক ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক পরিবেশ ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন।
প্রতিভাবান হিন্দুদের অধিক সংখ্যায় শাসনকার্যে নিয়োগ শুরু হয়, এমনকি তাদের সেনাক্ষের পদেও নিয়োগ শুরু হয়। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক বারবাক শাহের শাসনকালে অনন্ত সেন, জগন্নাথ রায়, নারায়ন দাস, বিশ্বাস রায়, গন্ধব্য রায় প্রমূখ উচ্চপদস্থ কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দ রায় ছিলেন রাজ পন্ডিত, অনন্ত সেন ছিলেন রাজ চিকিৎসক এবং বিশ্বাস রায় ছিলেন রাজ পন্ডিত। এইভাবে দেশে এক অ-সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
প্রতিভাবান হিন্দুদের অধিক সংখ্যায় শাসনকার্যে নিয়োগ শুরু হয়, এমনকি তাদের সেনাক্ষের পদেও নিয়োগ শুরু হয়। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক বারবাক শাহের শাসনকালে অনন্ত সেন, জগন্নাথ রায়, নারায়ন দাস, বিশ্বাস রায়, গন্ধব্য রায় প্রমূখ উচ্চপদস্থ কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দ রায় ছিলেন রাজ পন্ডিত, অনন্ত সেন ছিলেন রাজ চিকিৎসক এবং বিশ্বাস রায় ছিলেন রাজ পন্ডিত। এইভাবে দেশে এক অ-সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
সাহিত্যের অগ্রগতি
ইলিয়াস শাহীর বংশের সুশাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বাংলার শান্তি ও নিরাপত্তা- ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলা বিকাশের ক্ষেত্র পথ প্রশস্ত করেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এই যুগ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বংশের শাসনকালেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়। চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন- এ বাংলা ভাষার উত্তোলন এই যুগেই ঘটেছিল। অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, "বিদেশ থেকে এলেও কালস্রোতে ইলিয়াস শাাহীর সুলতানরা বাঙালি হয়ে যান এবং বাংলা ভাষা তাদের মাতৃভাষায় পরিণত হয়।বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এই বংশের প্রথম তিনজন শাসক- শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দার শাহ, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ এবং পরবর্তীকালে বারবাক শাহের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষনাবতী, গৌড় ও পান্ডুয়া উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক স্থানে পরিণত হয়। সুলতান বারবাক শাহ তার পান্ডিত্যের জন্য অল-ফাজিল ও অল-কামিল উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এই যুগেই কৃত্তিবাস প্রথম বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন। সফরনাম নামক ফরাসি শব্দকোষ রচয়িতা ইব্রাহিম কাইয়ুম ফারুকী, কবি কৃত্তিবাস ও সংস্কৃত পণ্ডিত বৃহস্পতি মিশ্র সুলতান বারবাক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিল।
বৃহস্পতি মিশ্রের বিখ্যাত গ্রন্থ হল "অমর কোষ" এর টিকা "পদচন্ডিকা"। বারবাক শাহ বৃহস্পতি মিশ্রকে পন্ডিত "সার্বভৌম" উপাধিতে ভূষিত করেন। "শ্রীকৃষ্ণ বিজয়" গ্রন্থের রচয়িতা মালাধর বসুকে "গুণরাজ খাঁ" উপাধি প্রদান করেন। বাংলার সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রতি ইলিয়াস শাহীর সুলতানদের এই পৃষ্ঠপোষকতা হোসেন শাহী আমলেও অব্যাহত ছিল।
স্থাপত্য শিল্পের অগ্রগতি
স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রেও ইলিয়াস শাহী যুগ স্মরণীয়। ইলিয়াস শাহী সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে এক স্বতন্ত্র শিল্পরীতি গড়ে ওঠে, যা অন্যান্য প্রদেশের শিল্পরীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক ছিল।কালের গ্রাসে শিল্পকৃতি বহু নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেলেও আজও সেসব অট্টালিকা, মসজিদ, দুর্গ কিংবা সমাধি টিকে আছে, তা বিস্ময়কর। ইলিয়াস শাহ হাজিপুর শহর নির্মাণ করে। সিকান্দার শাহ কর্তৃক নির্মিত পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। এছাড়া আলী সিরাজউদ্দিন, কোতোয়ালী দরওয়াজা প্রভৃতি শৌধ সিকান্দার শাহের আমলে নির্মিত হয়। শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত জামে মসজিদ, গৌড়ের বিখ্যাত লোটন মসজিদ, চামকাটি মসজিদ, তাঁতি পাড়া মসজিদ এবং হুগলি জেলার পান্ডুয়ায় বাইশ দরওয়াজা মসজিদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষার অগ্রগতি
শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই যুগ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলার নানা স্থানে এমনকি মক্কা ও মদিনাতে ইলিয়াস শাহী সুলতানরা বহু মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউসুুফ শা এক কলেজ নির্মাণ করেছিলেন। সুতরাং একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ইলিয়াস শাহী সুলতানদের আমলে বাংলায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল।তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী, "মধ্যকালীন ভারত"
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India"
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century"
সম্পর্কিত বিষয়
- সুফিবাদ (আরো পড়ুন)
- গুরু নানক কে ছিলেন (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................