ইলবারি তুর্কি বংশের শেষ সুলতান কায়কোবাদকে হত্যা করে জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি 1290 খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান হয়েছিলেন, ইতিহাসের এই ঘটনা খলজি বিপ্লব নামে পরিচিত।
মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক নিজামুদ্দিন ও ফেরিস্তার মতে, খলজিরা তুর্কি জাতির লোক ছিলেন। আফগানিস্তানের "খলজি" নামে স্থানে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে তারা খলজি উপাধি পায়। অন্যদিকে বরনী মতে, খলজিরা তুর্কি ছিলেন না, তারা ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর জামাতা কুলিজ খাঁর বংশধর। সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মাদ ঘুরির ভারত অভিযানের সূত্রে এরা ভারতে প্রবেশ করেছিল, যাইহোক তুর্কি আমীরদের কাছে খলজিরা হিন্দুস্তানি মুসলমান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি।
1287 খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যু হলে তার পৌত্র কায়কোবাদ দিল্লির সিংহাসনে বসেন। কায়কোবাদের বয়স ছিল তখন মাত্র 17 বছর। অল্পবয়স্ক এই সুলতান দিল্লির সিংহাসনে বসেই ভোগ-বিলাস, সুরা ও নর্তকীতে মত্ত হয়ে উঠেন। দিল্লির জনসম্মুক্ষে থেকে দূরে যমুনা নদীর তীরে কালিঘিরীতে প্রাসাদ নির্মাণ করে, সেখানেই আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজকার্য অবহেলিত হয়। সেই সুযোগে দিল্লির কোতোয়াল প্রবীণ ফকরউদ্দিনের জামাতা নিজামউদ্দিন প্রশাসনিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট হন। নিজামউদ্দিন ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দিল্লির সিংহাসনে প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি ছিল। নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে প্রথমে তিনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজ মনোনীত প্রার্থীদের নিয়োগ করতে শুরু করেন। মোঙ্গলদের জোট বেঁধে দিল্লীর সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অজুহাতে তিনি মোহাম্মদের পুত্র কাইখসরুরকে হত্যা করেন। কাইখসরুর সমর্থক বহু তুর্কী মালিকদেরও হত্যা করা হয়।
নিজামউদ্দিনের এই অত্যাচার, রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার কাইকোবাদ মেনে নিলেও তুর্কি আমীরদের তা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই নিজামউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পিতা বুুখরা খাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাইকোবাদ বিষ প্রয়োগ করে নিজামউদ্দিনকে হত্যা করেন। নিজামউদ্দিনের মৃত্যুর ফলে সুলতানি প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। কারণ নিজামউদ্দিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। নিজামউদ্দিনের স্থান পূরণের জন্য কাইকোবাদ বাধ্য হয়ে হিন্দুস্তানি মুসলিম গোষ্ঠীর নেতা জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজিকে সামানা থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং তাকে প্রধান সেনাপতি বা উজির-ই-মামলিকাৎ পদে নিয়োগ করেন। জালালউদ্দিন ছিলেন অভিজ্ঞ প্রশাসক এবং মোঙ্গল যুদ্ধে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
জালালউদ্দিনের এই পদ লাভে তুর্কি অভিজাতরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা হয় যে, জালালউদ্দিন কাইকোবাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সকল রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করবে এবং তুর্কিদের অপসারিত করে প্রশাসনের উচ্চচপদগুলিতে হিন্দুস্তানি মুসলিমদের বসিয়ে দিবে। এই সম্ভাবনা থেকে তারা "মালিক কাচ্চন ও মালিক সুরখা"-র নেতৃত্বে জালালউদ্দিনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হন এবং জালালউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তারা কাইকোবাদের জীবিত অবস্থায় তারই শিশুপুত্র কাইমুুুসকে তাকে শিশুপুত্রকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন।
তুর্কি গোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি তার অনুগামীদের নিয়ে দিল্লির অদূরে বাহারপুরে আশ্রয় নেন। তুর্কি গোষ্ঠীর নেতা মালিক কাচ্চন বাহারপুরে জালালউদ্দিনকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন। অতঃপর জালালউদ্দিন দ্রুত রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে শিশু সুলতান কাইমুুুসকে বন্দী করে বাহারপুরে নিয়ে আসেন। খলজিদের বাধা দিতে গিয়ে মালিক সুরখা সহ বহু তুর্কি আমীর নিহত হন। কাচ্চন ও সুরখার মৃত্যুর ফলে তুর্কিদের মনোবল ভেঙে যায়। বহু তুর্কি খলজিদের দলে যোগদান করে খলজি দলকে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে, এরপর যারা জালালউদ্দিনের নির্দেশে এক গুপ্তহত্যাকারী কালিঘিরীতে প্রবেশ করে কাইকোবাদকে হত্যা করে এবং শিশু কাইয়ুমকে কারারুদ্ধ করা হয়। অতঃপর মালিক ফিরোজ "জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ" নাম ধারণ করে কালিঘিরী প্রসাদের নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন(1290 খ্রিস্টাব্দে)। ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী ও কে. এস. লাল এই ঘটনাকে খলজি বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।
যমুনা নদীর তীর |
নিজামউদ্দিনের এই অত্যাচার, রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার কাইকোবাদ মেনে নিলেও তুর্কি আমীরদের তা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই নিজামউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পিতা বুুখরা খাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাইকোবাদ বিষ প্রয়োগ করে নিজামউদ্দিনকে হত্যা করেন। নিজামউদ্দিনের মৃত্যুর ফলে সুলতানি প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। কারণ নিজামউদ্দিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। নিজামউদ্দিনের স্থান পূরণের জন্য কাইকোবাদ বাধ্য হয়ে হিন্দুস্তানি মুসলিম গোষ্ঠীর নেতা জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজিকে সামানা থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং তাকে প্রধান সেনাপতি বা উজির-ই-মামলিকাৎ পদে নিয়োগ করেন। জালালউদ্দিন ছিলেন অভিজ্ঞ প্রশাসক এবং মোঙ্গল যুদ্ধে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
জালালউদ্দিনের এই পদ লাভে তুর্কি অভিজাতরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা হয় যে, জালালউদ্দিন কাইকোবাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সকল রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করবে এবং তুর্কিদের অপসারিত করে প্রশাসনের উচ্চচপদগুলিতে হিন্দুস্তানি মুসলিমদের বসিয়ে দিবে। এই সম্ভাবনা থেকে তারা "মালিক কাচ্চন ও মালিক সুরখা"-র নেতৃত্বে জালালউদ্দিনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হন এবং জালালউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তারা কাইকোবাদের জীবিত অবস্থায় তারই শিশুপুত্র কাইমুুুসকে তাকে শিশুপুত্রকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন।
তুর্কি গোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি তার অনুগামীদের নিয়ে দিল্লির অদূরে বাহারপুরে আশ্রয় নেন। তুর্কি গোষ্ঠীর নেতা মালিক কাচ্চন বাহারপুরে জালালউদ্দিনকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেই নিহত হন। অতঃপর জালালউদ্দিন দ্রুত রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে শিশু সুলতান কাইমুুুসকে বন্দী করে বাহারপুরে নিয়ে আসেন। খলজিদের বাধা দিতে গিয়ে মালিক সুরখা সহ বহু তুর্কি আমীর নিহত হন। কাচ্চন ও সুরখার মৃত্যুর ফলে তুর্কিদের মনোবল ভেঙে যায়। বহু তুর্কি খলজিদের দলে যোগদান করে খলজি দলকে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে, এরপর যারা জালালউদ্দিনের নির্দেশে এক গুপ্তহত্যাকারী কালিঘিরীতে প্রবেশ করে কাইকোবাদকে হত্যা করে এবং শিশু কাইয়ুমকে কারারুদ্ধ করা হয়। অতঃপর মালিক ফিরোজ "জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ" নাম ধারণ করে কালিঘিরী প্রসাদের নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন(1290 খ্রিস্টাব্দে)। ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী ও কে. এস. লাল এই ঘটনাকে খলজি বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।
খলজি বিপ্লবের তাৎপর্য বা গুরুত্ব
খলজি বিপ্লব ছিল মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা।
প্রথমতঃ ঐতিহাসিক কে. এস. লাল মতে, এই বিপ্লব কেবল একটি রাজবংশ থেকে অন্য রাজবংশের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাধারণ ঘটনা ছিল না। এটি ছিল তুর্কি একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের জেহাদ ও সাফল্যের নির্দেশনা। মামেলুক সুলতানদের পক্ষপাতমূলক নীতির ফলে কেবলমাত্র তুর্কিরাই শাসকগোষ্ঠীর মর্যাদা পেয়েছিল। যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও খলজিরা সাধারন কৃষিজীবী রূপে জীবন কাটাতে বাধ্য ছিল। কিন্তু এই বিপ্লব তুর্কি একাধিপত্যের অবসান ঘটায়।
দ্বিতীয়তঃ খলজি বিপ্লব একটি নতুন সাংবিধানিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তা হলো, দিল্লির সিংহাসনে বসার জন্য পবিত্র তুর্কির রক্ত বহনকারী দাস হওয়ার প্রয়োজন নেই। যোগ্যতা দক্ষতা থাকলেই যে কেউ এই পদ পেতে পারে।
তৃতীয়তঃ খলজি বিপ্লব প্রমাণ করে যে, ধর্ম এবং ধর্মগুরু বা উলেমাদের সাহায্য না নিয়েও রাজনৈতিক লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। ইলতুৎমিস কিংবা বলবন রাজনীতিতে উলেমাদের যেভাবে স্বীকার করেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রনীতির উপর ধর্মীয় প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ছিল। "ঈশ্বর সৃষ্ট রাজপদের সাফল্য ধর্মগুরুর শুভেচ্ছার উপর নির্ভরশীল"- এই তত্ত্বকে ফিরোজ খলজি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করেছিলেন। এর ফলে সুলতানি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র্র হিসাবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
সর্বোপরি এই বিপ্লব দিল্লির সিংহাসনে রাজবংশ পরিবর্তনের সাথে সাথে এক গতিশীল ও প্রানবন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার সূচনা করে। খলজি বংশের সুলতান আলাউদ্দিন খলজী সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তার করে দিল্লি কেন্দ্রিক উত্তর ভারতে একটি রাজ্যকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের পরিণত করেন। বলা যায় খলজি বিপ্লব খলজি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করে। শুধু তাই নয়, আলাউদ্দিন খলজী স্থায়ী সেনাবাহিনীর গঠন, রাজস্ব নীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্ররণ নীতির মতো বহুুুু প্রকার শাসন সংস্কার করে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এক কথায় খলজি বিপ্লব ভারতের ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করেছিল।
তথ্যসূত্র
- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী, "মধ্যকালীন ভারত"
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India"
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century"
সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
......................................................