ভারতের প্রাচীনতম ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা হলো সিন্ধু সভ্যতা। এই সভ্যতার প্রাচীনত্ব, উৎপত্তি ও শ্রেষ্ঠা কারা- এনিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু হরপ্পা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ একমত হয়েছেন এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই সভ্যতার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা থেকে আলোকপাত করেছেন।
সিন্ধু সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন
এই নগর সভ্যতার অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি-গ্রাম অঞ্চলের ব্যাপকহারে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য, যা নাগরিক জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছিল। এই যুগে কৃষিজাত পণ্য গুলি যথাক্রমে- গম, যব, বার্লি নানাধরনের তৈলবীজ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো।
হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান, লোথাল প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হতো। এই সময় কৃষি বাজারে আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সেচ ব্যবস্থা। সিন্ধু সভ্যতার যুগে পশুপালন ছিল অর্থনীতির জীবনের উপরে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
এই যুগে বিশেষ করে গো সম্পদের উপর ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো। এই থেকে পণ্ডিতদের অনুমান যে- গরু, মহিষ এবং ষাঁড়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। মূলত জমি কর্ষণ কাজে মহিষ ও ষাঁড়কে ব্যবহার করা হতো। এই যুগে পালিত পশু হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিল গরু, ছাগল, ভেড়া, উট প্রভৃতি।
সিন্ধু সভ্যতার ব্যবসা-বাণিজ্য
কৃষি অর্থনৈতিক সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য যুক্ত হয়ে হরপ্পার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে ছিল। স্থলপথে বাণিজ্য চলত দুই চাকা বিশিষ্ট আধুনিকতার এক্কা জাতীয় গাড়ি, সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও কারিগরি শিল্পের সাথে বাণিজ্য ছিল প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই মহীশূর কোলার অন্তপুর জেলায় খনি থেকে আনা হতো সোনা, তামা, সিসা, চুনাপাথর প্রভৃতি।
আফগানিস্তান ও পারস্য থেকে আসতো রাজু, নাবীর মতো উন্নতমানের নীলকণ্ঠ মনি। মধ্য এশিয়া থেকে আসতো শ্বেতপাথর। এই সময় মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন থাকায় পণ্য ছিল বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। তাই ভারত রপ্তানি করতো কার্পাস জাতীয় বস্ত্র, তামা তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
সিন্ধু সভ্যতার শিল্প
বাণিজ্য সঙ্গে শিল্প ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কারিগরি শিল্প এই সভ্যতাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিলো। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান, লোথাল প্রভৃতি শহরে উন্নত ধরনের ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, নগর, দুর্গ, স্নানাগার এবং সর্বোপরি জল নিকাশি ব্যবস্থা করে প্রমাণ করে যে, এই যুগে অসাধারণ দক্ষ শিল্প ছিল- যারা প্রধানত নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়াও সোনার তৈরি কারুকার্য পূর্ণ গয়না শিল্প এই যুগের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি শিল্প সংহার স্ফুরিত ঘটিয়ে ছিল।
সামাজিক অবস্থা
সিন্ধু সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনার সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, স্নানাগার, ঘর-বাড়ি নির্মাণের কৌশল- এইসব কিছুই প্রমাণ করে যে, হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা উন্নতমানের সামাজিক জীবনযাত্রা পালন করে। ঐতিহাসিক বেসাম সিন্ধু সভ্যতার নাগরিক জীবন-যাপন পদ্ধতি উল্লেখ করে বলেছেন যে- সিন্ধু উপত্যকায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল বেশি।
খাদ্য
সিন্ধু অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, বার্লি, খেজুর প্রভৃতি ছাড়াও তারা নানা ধরনের ফলমূল ও শাকসবজি, শুকরের মাংস, কচ্ছপ, হাঁস প্রভৃতির মাংস ও দুধ ছিল তাদের অন্যতম খাদ্য সামগ্রী।
পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার
সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত মূর্তি থেকে সেই যুগের পোশাক-পরিচ্ছদের নিদর্শন পাওয়া যায়। পোশাকের উপর দিকটা সালের মতন এবং নিচের অংশটি ধুতির মত দেখতে হত। স্ত্রী এবং পুরুষের পোশাকের মধ্যে বিশেষ কিছু ফারাক ছিল না। পোশাকের জন্য তুলো এবং হয়তো পশম ব্যবহার করা হতো। স্ত্রী-পুরুষের অলংকার পড়তে ভালোবাসতেন। বিচিত্র রকমের আংটি, গলার হার পাওয়া গেছে। অলংকার নির্মাণে সোনা, রুপা এবং নানা রকমের মূল্যবান ধাতু পাওয়াা গেছে।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিস
সিন্ধু সভ্যতার মাটির পাত্র, তামার পাত্র, চিনামাটির পাত্র, রুপা-বোঞ্চ নির্মিত পাত্র প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জিনিস পাওয়া গেছে। নানাপ্রকার তীর ধনুক প্রভৃতি জিনিস ব্যবহৃত হতো। খাট, চেয়ার, টেবিল, টুল এবং আলো দিয়ে বৈঠক ঘর সাজানো হতো। অবসর সময় বিনোদনের জন্য তারা খেলাধুলা, শিকার করা, ষাড়ের লড়াই খুব পছন্দ করত।
জীবিকা
সিন্ধু উপত্যকার বাসীদের উপজীবিকা ছিল কৃষি ও পশুপালন। এছাড়াও বহু মানুষের কথা জানা যায়, শিল্পকলা নির্মাণে যেমন- অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর প্রভৃতি কাজে সঙ্গে নিযুক্ত ছিলেন।
ধর্মীয় বিশ্বাস
সিন্ধু অঞ্চলে আবিষ্কৃত সীলমোহর ও মূর্তি থেকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায়। সিন্ধু বাসিদের বৃক্ষ, অগ্নি, জল প্রভৃতির উপাসনা করত। সেকালের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল মূর্তিপূজা। সিন্ধু সভ্যতায় তিনটি সিংহ বিশিষ্ট একযৌগি পুরুষের একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। মনে করা হয় যে, এই মূর্তিটি পরবর্তীকালে হিন্দু দেবতা মহাদেব শিবের পূর্বসংষ্করণ।যাইহোক এই উপত্যকায় মানুষদের মধ্যে গাছপালা, নদ-নদী, প্রাকৃতিক শক্তি ও বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রচলিত ছিল।
তথ্যসূত্র
- সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস" (প্রথম খন্ড)
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
সম্পর্কিত বিষয়
- ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা (আরো পড়ুন)
- বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
- প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ| আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো| আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন|
.......................................