গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন

গুপ্ত বংশের শাসনকাল ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। রাজনৈতিক অনৈক্য ও সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সাংস্কৃতিক স্থাপত্যের বিরোধিতার অবসান ঘটিয়ে গুপ্তরা ভারতবাসীর জীবনে এক প্রাণের জোয়ার এনেছিলেন।

কোন কোন পন্ডিতের মতে, ভারতের ইতিহাসের আর কোন পর্যায়ে মানুষের জীবনে এত সুখময় ছিল না। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ভারতের যে সার্বিক উন্নতি গুপ্ত শাসনে পরিলক্ষিত হয়েছিল, সেই দিকে তাকিয়ে ঐতিহাসিক বার্নেট গুপ্ত যুগকে প্রাচীন গ্রিসের পেরিক্লিসের যুগ সাথে তুলনা করেছেন।

আবার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অভূতপূর্ব বিকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ গুপ্ত যুগকে ভারতের ইতিহাসের ধ্রুপদী যুগ বা Classical Age বলে মন্তব্য করেছেন।

গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন
গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন


রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন

কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছিল‌। সেই রাজনৈতিক ঐক্য ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে গুপ্ত রাজাগণ এক সুনির্দিষ্ট ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গঠন করে ভারতবাসীকে নিরাপত্তা দান করেছিল। এমনকি একাধিক বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে নিশংস হত্যা ও লুণ্ঠনের বিপর্যয় থেকে ভারত ভূমিকে রক্ষা করেছিল।


গুপ্ত যুগের শাসন ব্যবস্থা

সাম্রাজ্যের সংগঠন নয় বরং সুশাসন প্রবর্তন ও গুপ্ত রাজাগণও যথেষ্ট দক্ষতা প্রবর্তন করেছিল। স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সত্ত্বেও গুপ্ত রাজারা ছিলেন বিকেন্দ্রীকরণ শাসন ব্যবস্থার সমর্থক। প্রদেশ বা জেলা পর্যায়ে গুপ্তযুগে সুনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার সংহতি ছিল, এর ফলে স্থানীয় সম্পদ স্থানীয় উন্নয়নে ব্যয় হতো। এমনকি অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেবার নীতি ছিল।


গুপ্ত যুগের অর্থনীতি

গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন

কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতির প্রচলন ও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই যুগের কৃষির উৎপাদনের সচেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনকি বিখ্যাত সুদর্শন হ্রদের সংস্কার গুপ্ত যুগের কীর্তি। বস্ত্রশিল্প, লৌহ শিল্প, তাঁত শিল্প, চর্ম শিল্প, ধাতু শিল্প, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগ ছিল যথেষ্ট অগ্রণী।


গুপ্ত যুগের সমাজ ব্যবস্থা

সামাজিক ভেদাভেদও ঐ যুগে বহুলাংশে হাস পেয়েছিল। সামাজিক ক্ষেত্র ভেদ থাকলেও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের মতো বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এমনকি গণিকার কন্যার সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টান্ত দেখা যায় এবং গুপ্তযুগের শূদ্রদের অবস্থা অনেক উন্নতি হয়েছিল।


গুপ্ত যুগের সাহিত্য ও দর্শন

গুপ্ত যুগের সাহিত্যের যে ব্যাপক চর্চা হয়েছিল এবং যে পরিমাণ অমর সৃষ্টি হয়েছে কেবল তার বিচার এই গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বা স্বর্ণযুগ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। গুপ্তযুগে বহুসংখ্যক খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল। কবি কালিদাস, বিশাখা দত্ত, বিষ্ণু শর্মা প্রমূখগণ গুপ্ত যুগকে গৌরবিত করেছেন। আর্য ভট্ট, বরাহমিহির প্রমূূখ চন্দ্র সূর্যের অবস্থান, দিনরাত্রির আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করে অজানা বহু বিষয়ে ভারতবাসীকে সচেতন করেছেন। চিকিৎসা শাস্ত্রেও এই যুগে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে।


গুপ্ত যুগের স্থাপত্য

গুপ্ত যুগের শিল্পের তিনটি ধারা- স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা বিষয়ক উন্নতি ঘটেছিল। 

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যে, এগুলি ছিল ভারতীয় এবং সহজ সরল গঠন পদ্ধতি। আর.বি. ব্যানার্জীর মতে, ভারতের শিল্প কলা দীর্ঘদিনের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে গুপ্ত যুগের সক্রিয় বৈশিষ্ট্যের প্রতিভায় হতে পেরেছিল।


গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য

গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন
গৌতম বুদ্ধ

গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য বহু নির্দিষ্ট পৌরাণিক দেব-দেবীর মূর্তি খননের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। সারনাথে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ মূর্তি গুলি এযুগের ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ছিল। মূর্তিগুলো ছিল আশ্চর্য রকমের সাবলীল এবং রেখার স্পষ্টতা ছিল গুপ্ত যুগের ভাস্কর্যের যে মথুরা ও অমরাবতীর ভাস্কর্যের পরিণত রুপ বলা যায়।


গুপ্ত যুগের চিত্রকলা

গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন
অজন্তা গুহা


ভাস্কর্যের মতো গুপ্ত চিত্রকলা ছিল প্রাণবন্ত। অজন্তা গুহার দেওয়ালে আঁকা চিত্রগুলি যেমন সজ্জিত তেমনি স্বাভাবিক। এখানে রাজা-রানী, রাজ প্রসাদ থেকে শুরু করে অপ্সরা, ভূত-পেত্নী সবকিছুর বিষয়ের বস্তুর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


বিরুদ্ধ মত

বিরুদ্ধ মতে সার্বিক উন্নতি থাকা সত্ত্বেও এই যুগকে সুবর্ণ যুগ বা স্বর্ণযুগ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত সম্মত, সেই বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে, যেমন- 
  1. আধুনিক গবেষকের মতে গুপ্তযুগে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল তা সত্য, কিন্তু  তার সাথে হৃদয়ের যোগ ছিল না। এদের মতে গুপ্তযুগে আবদ্ধ সচ্ছলতার অন্তরালে সাধারণ মানুষের দরিদ্র ছিল প্রকট।
  2. নারীদের অবস্থা বিশেষ উন্নতি গুপ্ত যুগের ঘটেনি। মনু স্মৃতিতে নারীর স্বাধীনতা সংকুচিত করে বলা হয়েছে যে- "নারীর সারা জীবন অন্যের অধীনে থাকে, শৈশবে পিতা-মাতার অধীনে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে"। 
উপরিউক্ত ত্রুটিসমূহ থাকা সত্ত্বেও গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতকে সুবর্ণ যুগ বা স্বর্ণযুগ বললে ভুল হবে না। 


তথ্যসূত্র

  1. সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস"।
  2. Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".

সম্পর্কিত বিষয়

  1. রেনেসাঁ ও মানবতাবাদ  (আরো পড়ুন)
  2. ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা (আরো পড়ুন)
  3. বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)
  4. প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য  (আরো পড়ুন)
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
                     .......................................

    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐