প্রাচীন গ্রিসের হেরোডোটাস বা থুকিডিডিস মতো প্রাচীন ভারতে সেই সময় ছিল না। সেই সময় বেশিরভাগই ছিলো রচনা ধর্মীয় সাহিত্য। আবার সেইসব সাহিত্য গুলির মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্য। এইসব ধর্মীয় সাহিত্যগুলি মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিক থেকে রচিত হলেও তা সত্যেও এই সমস্ত সাহিত্যগুলি থেকে ইতিহাসের বহু তথ্য পাওয়া যায়।
![]() |
থুকিডিডিস Source - click here |
বৈদিক সাহিত্যে গুলো ছিলো প্রাচীন ভারতের প্রধান ধর্মীয় সাহিত্য, উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। এই সবগুলো নিয়ে বৈদিক সাহিত্য সম্ভার হিসাবে হিসাবে ধরা হয়। ঋকবেদের রচনাকাল হিসাবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ - ১০০০ অব্দ পর্যন্ত ধরা হয় থাকে। এই ঋগ্বেদ থেকে তৎকালীন সামাজিক জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক জীবন জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ও ধর্মীয় চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।
আবার পরবর্তী বেদগুলি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১০০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ধরা হয়ে থাকে এবং এই সময়কে ইতিহাসের পাতায় পরবর্তী যুগ হিসেবে ধরা হয়। ইতিহাস ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বৈদিক যুগের সাহিত্য গুলির মধ্যে স্মৃতিশাস্ত্রগুলির কথা বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন- মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, বশিষ্ট্য স্মৃতি, বৃহস্পতিস্মৃতি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে ধর্মের শাস্ত্র গুলির উপর বিভিন্ন টিকা রচিত হয়েছে যেমন- মনুস্মৃতির উপর রচিত হয়েছে কুল্লুকভট্ট ও মেধাতিথির টীকাভাষ্য। এই ধর্মীয় স্বাস্থ্য গুলি থেকে তৎকালীন সামাজিক জীবনে জীবন যাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় এবং তার সাথে রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিধি নির্দেশ ও উপদেশ বলিও বহু তথ্য পাওয়া যায়। আবার প্রাচীনকালের ব্যবসা-বাণিজ্য, কারিগর শিল্প, নারীর অবস্থানহ সামাজিক অবস্থান, বিধবা বিবাহ প্রথা, বর্ণ ব্যবস্থা প্রভৃতি বহু তথ্য এই স্মৃতি শাস্ত্র গুলি থেকে পাওয়া যায়। এই স্মৃতি শাস্ত্র গুলির টিকা পরবর্তীকালে রচিত হওয়ার ফলে পরবর্তীকালে কিভাবে ধর্ম শাস্তির বিধান গৃহীত হচ্ছে- তা সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।
রামায়ণ এবং মহাভারত এই দুটি প্রকৃতপক্ষে মহাকাব্য হিসেবে ধরা হয়ে থাকে এবং এর সঙ্গে সনাতনী হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িত থাকার ফলে একে ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা গণ্য করা আশাকরি কিছু ভুল হবে না। এই রামায়ণ রচিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আবার মহাভারত ধর্মীয় গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মহাভারতের মূলত আমরা জানতে পারি, গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের কুরু-পান্ডবদের মহাযুদ্ধের কথা।
আবার রামায়ণ ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি শ্রী রামচন্দ্রের আদর্শ এবং রাজ্যের প্রতি একজন আদর্শ রাজার কর্তব্য তৎকালীন সামাজিক জীবন ও সামাজিক জীবন প্রভৃতি। আবার মহাভারত থেকে যুদ্ধের চেয়ে বাস্তবতা তা আমরা লক্ষ্য করে থাকি। তবে যাই হোক না কেন এই দুই ধর্মগ্রন্থ থেকে ভারতীয় সমাজ ও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ছিল যে চরিত্র সম্পর্কে আমাদের বিশেষ ধারণা দিয়ে থাকে তা ইতিহাস পাঠক হিসেবে আমাদেরকে ক্ষেত্রে তৎকালীন সমাজ জীবনের পরিচয় পেতে অনেকটাই সাহায্য করে।
![]() |
যুদ্ধ |
ভারতীয় সনাতনী ধর্মীয় কন্ঠ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল পুরান সমূহ এবং এই পুরাণের সংখ্যা হলো ১৮টি। পুরান সমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল- শেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ, কূর্ম পুরাণ, অগ্নিপুরাণ ও বায়ু পুরাণ প্রভৃতি। এই পুরানগুলির রচনাকাল কখনই গুপ্ত যুগের আগের হিসেবে ধরা হয় না এবং পুরানগুলির রচয়িতা গন যেসব বর্ণনা করেছেন তা আসলে নকল ভবিষ্যৎবাণী। এবং পুরান গুলি সম্পর্কে সর্বদাই একটা সংশয় থেকে যায় তবে অন্যান্য উপাদান তথ্যের উপর যাচাই করে কুরআনের তথ্য ঐতিহাসিকের গণের মধ্যে সর্বদা ব্যবহার হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অধ্যাপক রামশরন শর্মা তাঁর সামন্ততন্ত্রের তথ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে পুরানের বহু তথ্য ব্যবহার করেছেন।
ভারতবর্ষের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম প্রধান প্রাচীন দুটি ধর্ম হলো বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম। এই বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে যেমন- ত্রিপিটক, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, ললিতবিস্তর, হেমচন্দ্রের ত্রিষষ্ঠীশলাকাপুরুষচরিত প্রভৃতি। আর জৈন ধর্মের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হলো- জৈন সূত্রাবলী, আচারঙ্গ সূত্র প্রভৃতি। এইসব ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে সামাজিক রাজনৈতিক আর সংস্কৃতিক, লোকজীবন বহু তথ্য পাওয়া যায় যা ইতিহাস পাঠক হিসাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত।
![]() |
গৌতম বুদ্ধ |
সর্বশেষে এই কথা বলা যায় যে, ধর্মীয় গ্রন্থ গুলি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ঐতিহাসিক তথ্য সরবরাহ করে। আবার এই ধর্মগ্রন্থের উপাদান সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সততা যাচাই করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। আবার প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় গ্রন্থ গুলির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে খাটো চোখে দেখা যায় না এবং তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাইহোক তৎকালীন সময়ে ইতিহাসের গ্রন্থ ছিলো না, ছিল ধর্মীয় সাহিত্য এবং ধর্মীয় গ্রন্থ গুলি এবং প্রাচীন ইতিহাসের রচনার ক্ষেত্রে সেইসব গ্রন্থ গুলি একমাত্র ভরসা হয় উঠে ঐতিহাসিকদের ক্ষেত্রে।
👉তথ্যসূত্র
- সুনীল চট্টোপাধ্যায় "প্রাচীন ভারতের ইতিহাস" (প্রথম খন্ড)।
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
👉সম্পর্কিত বিষয়📖
- মগধের উত্থানের কারণ (আরো পড়ুন)
- ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা (আরো পড়ুন)।
- বৈদিক এবং ঋক বৈদিক যুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
- প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন🌐।