সুফিবাদের মতাদর্শ ও ভাবধারা
ইসলামের ধর্মের রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের উদার সংস্কারবাদী, অতীন্দ্রিয়বাদী যে ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করেন, তা সুফিবাদ নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মের সূচনা কাল থেকেই সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে এবং তা ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করে ইসলামী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
📖ইসলামের সুফিবাদ মতাদর্শ কতগুলি নীতি তত্ত্ব ও ভাব দর্শনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, সেগুলি নিম্নরূপ----
👉প্রথমত:- সুফি মতাদর্শ কেন্দ্রীয়বাদের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন ইন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বারা নয়, আত্মশুদ্ধি পবিত্র চিত্র ও আধ্যাত্মিক জীবন চর্চার দ্বারা আল্লাহর প্রেম ও সান্নিধ্য লাভ করা যায়।
👉দ্বিতীয়তঃ- সুফিবাদের বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়া-কলাপ অপেক্ষা অন্তরের পবিত্রতা এবং সাংসারিক ভোগ বিলাসের অভাব বদলে বৈরাগ্য সাধনকে গুরুত্ব দেয়। ধর্মের দিক থেকে ঈশ্বর তথা আল্লাহর আত্মিক মিলন ব্যক্তিজীবনের একমাত্র সার্থকতা বলে সুফি মতাদর্শে উল্লেখ করা হয়। তবে এই মিলন কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা আরম্ভর পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে নয়, তা হবে একান্তভাবে আন্তরিক ও হৃদয় প্রত্যুষ ঈশ্বর ও ব্যাক্তি মানবী মিলনের মধ্য দিয়েই মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বায় ঈশ্বরীক সত্তায় রূপান্তরিত হয়।
👉তৃতীয়তঃ- প্রথমদিকে সুফিবাদে সন্ন্যাসবাদ ও নিষ্ক্রিয়বাদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে ক্রমে সুফিবাদ সন্ন্যাসবাদ থেকে পৃথক হয়ে পড়ে, কারণ সন্ন্যাসবাদে সর্ব সুখ লাভের জন্য ইহ লৌকিক সুখ ত্যাগ করার নির্দেশ ছিল, কিন্তু সুফিরা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করার জন্য সুখ-সমৃদ্ধি পরিত্যাগ করতো। প্রাচীন সুফিবাদের কোরআন হাদিসের বাণীকে মূল মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে শরিয়াত নির্দিষ্ট আচারবিধি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। ক্রমে সুফিবাদে ঈশ্বর প্রেমী এক ও অদ্বিতীয় প্রন্থা হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে।
👉চতুর্থত:- ক্রিস্টিয়ানাবংশ শতকের প্রথমার্ধের সুফিবাদ খ্রিস্টান বৌদ্ধ হিন্দু জোর রাষ্ট্রীয় ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেখানে মানুষকে এই সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ বাস স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব আর মানব দেহেয় আল্লাহর অবস্থান ও পূর্ণ অভিব্যক্তি।
👉পঞ্চমত:- সুফি সাধনার লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়- মানব সত্তার ধ্বংস ও ঈশ্বর সত্ত্বায় অবস্থিতি মানব সত্ত্বায় বিলায় বা ধ্বংসকে বলা হয় ফানা। এবং ঈশ্বর সত্ত্বায় অবস্থিত বলা হয় বাঁকা। বাস্থিতি, হুজি ইরি, গজ্জালি প্রমুখ সুফি লেখকরা বলেন- ফানার অর্থ আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ অর্থাৎ সুফিবাদ দার্শনিক মুক্তি মূলক জ্ঞান বাদ নয়, এটি অনুভূতিমূলক ভাবাবেগ নয়।
👉ষষ্ঠত:- সুফি মতাদর্শে গুরুবাদ অপরিহার্য সুফিবাদে গুরু বা পীর বা শীর্ষ বা মুরিদকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের সঠিক পথ দেখান গুরু বা পীরের সান্নিধ্য ছাড়া মানবতার সাথে আল্লাহর মিলন ও তার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব নয়।
👉সপ্তমত:- সুফি মতাদর্শের সর্বোত্তম আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভের জন্য দশটি পর্ব অতিক্রম করতে হয়, সেগুলি হল তওবা, ওয়ারা, যুহুদ, হকার, শবর, শুকর, রাজা, তাওয়া কুল ও রোজা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের এই দশটি প্রায় অতিক্রম করায় হলো সুফিবাদের লক্ষ্য। এবং তা অতিক্রম করতে সফল হলে আধ্যাত্মিক উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাবে।
👉অষ্টমত:- সুফিবাদে ঈশ্বরের একত্ব ও অদ্বিতীয় তত্ত্বের ধারণাকে মূল তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, অর্থাৎ কোরআনের নির্দেশ মেনে সুফিরা মরমিয়া বা ইসলামের প্রকৃত অধিকারীদের জন্য কোরআনের গুপ্ত অর্থ বা কাতিন এর নির্দেশকে গ্রহণ করেছেন।
📖মূল্যায়ন:- সুফিবাদ হলো ইসলামের কোরআনের অনুসারী, রহস্যবাদী, অতীন্দ্রিয় মতবাদ। যার লক্ষ্য ছিল- মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আর এই বিশ্বাস স্থাপনের জন্য সুফিবাদের সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ আচরণের বধি ও নৈতিক ক্রিয়া-কলাপের কথা বলা হয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুফিবাদের উদ্ভব প্রসার ঘটিয়েছিল, যে রক্ত খয়েরী সংগ্রাম ধর্মীয় সরলতা গোড়ামী ধর্ম বিদ্বেষ থেকে সাধারণ মানুষের জীবনকে সততা, পবিত্রতা সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে ফিরিয়ে দিতে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিল, তা এক কথায় অবিস্মরণীয়।
............. সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
👉তথ্যসূত্র
- সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"।
- অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"।
- V D Mahajan, "History of Medieval India".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- মধ্যযুগীয় ভারতের ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব (আরও পড়ুন)।
- ভারতবর্ষে মুঘল বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি ও কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা (আরো পড়ুন)
- মনসবদারি ব্যবস্থা এবং পরবর্তীকালে জায়গির সংকট (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।