পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহৎ সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বহু রাজসিংহাসন কালে নির্মম আঘাতে মলিন হয়েছে। বহু স্বৈরাচারী শাসক কাল গর্বে বিলীন হয়ে গেছে। বহু স্পর্ধিত রাজদন্ড ভুলন্ঠিত হয়েছে। কিন্তু শিবাজী আপন দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে যে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তা আজও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আসে - "He was the friend of the poor and downtrodden".
👉 শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি
শিবাজী ১৯৭৪ সালের রায়গর দুর্গে ছত্রপতি ও গো বাহ্মণ প্রতিপালক উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহন করেন। মধ্যযুগের সব সুলতান ও সম্রাটের মতো শিবাজীর শাসন ব্যবস্থাও ছিল স্বৈরতন্ত্রী। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রী হলেও তিনি স্বেচ্ছাশালী ছিলেন না। তিনি অষ্টপ্রধান নামে আট জন মন্ত্রী উপর শাসন ক্ষমতা ন্যাস্ত করেছিলেন। এই মন্ত্রীদের মধ্যে প্রধান হলেন পেশুয়া বা প্রধানমন্ত্রী। অন্যদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন দেবীর, ন্যায়ধীশ, পন্ডিতরাও, নৌসেনাপতি।
👉 শিবাজীর কেন্দ্রীয় শাসন
কেন্দ্রীয় শাসনের শীর্ষে ছিলেন শিবাজী স্বয়ং। তিনি অষ্টপ্রধানের সাহায্যে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন এবং রাজাকে সাহায্য করার জন্য একটি পরিষদ ছিল। প্রয়োজনে সম্রাট সেই পরিষদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে পারতেন। শিবাজীর শাসন কাঠামো প্রবর্তিত ছিল কেবলমাত্র স্বরাজ্যভুক্ত ভূখণ্ডের উপর। সামরিক-অসামরিক প্রশাসনের ছত্রপতি শিবাজী স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন।
👉 অষ্টপ্রধান
অসামরিক প্রশাসনে ছত্রপতির পরেই ছিল অষ্টপ্রধানের প্রদান। অষ্টপ্রধান হলেন আটজন মন্ত্রী। অষ্টপ্রধানের মধ্যে পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদারধিকারী। তিনি সমস্ত শাসনব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করতেন, রাজার অবর্তমানে তার প্রতিনিধিত্ব করতেন। বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করতেন। অষ্টপ্রধানের পরবর্তী স্তরে মজুমদার বা অমর্ত্য ছিল অর্থমন্ত্রী। রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসেব পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর কাজের অন্ধভক্ত ছিল। অষ্টপ্রধানের পরে ছিলেন ওয়াকিনবিশ বা মন্ত্রী।
রাজার দৈনন্দিন কার্যাবলী ও দরবারের বিবরণী তার লিপিবদ্ধ করতেন এবং রাজার দৈহিক নিরাপত্তা সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতেন। এর পরের সূত্রে সর্নাবিশ বা সচিব রাজকীয় চিঠিপত্র যথাযথভাবে মুসাবিদ করা তত্ত্বাবধান করতেন। এছাড়া সুমন্ত বা দেবীর যিনি বিদেশ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান স-ই-নৌবত বা সেনাপতি। এরপরে ছিলেন পন্ডিতরাও বা মুহতাশিব যিনি ধর্মীয় বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। সর্বশেষে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ন্যায়াধীশ বা কাজী-উল-কাজাৎ। তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন।
👉 প্রাদেশিক শাসক
শিবাজী তার রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। এই প্রদেশ গুলিতে একজন করে রাজ কর্মচারী নিয়োগ করতেন। সর্বনিম্ন স্তর ছিল গ্রাম যার শাসন কার্য পরিচালনা করতেন গ্রাম প্রধান। কয়েকটি গ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন দেশমুখ ও দেশপান্ডে। শিবাজীর শাসন অঞ্চল দুটি ভাগে বিভক্ত- স্বরাজ্য ও মুলকাগিরি। যে অঞ্চলে শিবাজীর প্রত্যক্ষ শাসন চালু ছিল তা হল স্বরাজ্য আর তার পার্শ্ববর্তী রাজ্য যেখানে প্রতিবছর মারাঠা সেনারা লুটপাট চালাত।
👉 রাজস্ব
শিবাজী রাজস্ব ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করেন। তাঁর রাজ্যের দুই ধরনের রাজস্ব প্রদান করা হতো- চৌথ ও সরদেশমুখী। শিবাজী নিজ রাজ্যের মারাঠাদের কাছ থেকে উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ সরদেশমুখী নিতেন। আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও নিজ রাজ্য থেকে চৌথ হিসাবে ১/৪ অংশ আদায় করা হতো।
👉 সেনাবাহিনী
শিবাজী পার্বতী মাওয়ালিদের নিয়ে একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী গঠন করেন। তাঁর সেনাবাহিনী অশ্বারোহী, রথারোহী, পদাতিক সেনা নিয়ে গঠিত ছিল। সেনাবাহিনীতে সেনারা ছিল দুই ধরনের, যথা- বর্গি ও শিলাদার। শিলাদাররা ছিল স্থায়ী সৈন্য যারা রাজ্য থেকে অস্ত্রশস্ত্র, বেতন ও অশ্ব পেতো। বর্গী ছিল ভাড়াটে সেনা যারা কেবলমাত্র যুদ্ধের সময়ই টাকা পেত।
👉 বিচার ব্যবস্থা
বিচার ব্যবস্থায়ী রাজায় ছিল সর্বেসেবা। এছাড়া প্রতি প্রদেশে বিছালয় থাকতো বিচারালয় থাকতো। বিচার দ্বন্দ্ব ছিল কঠোর।
📖 মূল্যায়ন
আওরঙ্গজেব এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন শিবাজী। "He was not a religious bigot like his contemporary Aurangazeb. তিনি ছিলেন অতিশয় সংবেদনশীল, পরধর্মসহিষ্ণু, নারী-শিশু, ধর্মস্থান, ধর্মগ্রন্থ জন্মস্থান ধর্মগ্রন্থ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------