উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় সংস্কার আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। রামমোহন রায় ধর্ম ও সমাজ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যোগসূত্র গড়ে তুলেছিলেন। ডিরোজিও ও তার নববঙ্গ গোষ্ঠী হিন্দুধর্ম, সনাতন সমাজ ব্যবস্থার উপর কোশাঘাত আনেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (1820-1891) ধর্মকে সংযুক্ত না করে মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ সংস্কার আন্দোলন ব্রতী হন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর |
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন আপেশহীন নির্বিক যোদ্ধা, বিভিন্ন যুক্তির দ্বারা তিনি হিন্দু সমাজে আচার ও কুসংস্কার গুলির ওপর প্রচন্ড আঘাত হানেন। রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ তাকে বাঁধা দেয়, কিন্তু তিনি আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন "এই ভিরুর দেশে তিনি ছিলেন একমাত্র পুরুষ সিংহ " কোন বাধা বিপত্তির সামনে বিদ্যাসাগর মাথা নত করার ছিলেন না। তাই রবীন্দ্রনাথ আরও একজায়গায় বলেছেন,- " আমাদের এই অমানবিক দেশে ঈশ্বর চন্দ্রের মতো আদর্শ পুরুষ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারিব না"। "কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাওয়া যায়, মানব ইতিহাসে বিধাতার সেইরূপে গোপনে, কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়েছিলেন"।
তখন হিন্দ সমাজে 'বিধবা বিবাহ' কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। অল্প বয়সী বিধবাদের জীবন-যন্ত্রণা বিদ্যাসাগরকে গভীরভাবে মর্মাহত করেন। তাই তিনি বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের জন্য সক্রীয় ভূমিকা নেন। তার প্রভাবে এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির অনুমোদন ক্রমে 1855 সালে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইনটি পাশ হয়। এই আইনকে পরিস্রুত করার জন্য তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপককে বর্ধমান জেলার দশ বছরের বিধবা কন্যা কালিমতি দেবীর সঙ্গে বিবাহ দেন। এই বিবাহের পরের দিন কলিন পাত্র চব্বিশ পরগনার পানিহাটি গ্রামের মধূসুদন ঘোষের সঙ্গে ইশানচন্দ্র মিত্রের বারো বছরের বিধবা কন্যার বিবাহ হয়। তিনি তাঁর নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্রকে ভবসুন্দরী নামে একজন বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন। তিনি তার ভাই শম্ভু চন্দ্রকে এক চিঠিতে লেখেন- "আমি বিধবা বিবাহের প্রবর্তক আমার উদ্যোগে অনেক বিধবার বিবাহ দিয়েছি, এমন স্কুলে আমার পুত্র বিধবা বিবাহ না করিয়া আমার কথায় কুমারী মেয়েকে বিবাহ করিলে, আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিব না"।
তবে বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগর যে প্রানপন চেষ্টা করেছিলেন তা পুরোপুরি সফল হয়নি। কারণ বিদ্যাসাগরের পাশে দাঁড়ানোর মতো লোকের সংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু এতটা সত্ত্বেও নির্ভিক এই যোদ্ধার সংস্কার আন্দোলন পিছিয়ে পড়েননি। প্রবল আত্মবিশ্বাস এই দয়ার সাগর বিধবা বিবাহের আনন্দ উপভোগ করেন। তিনি তাঁর ভাই শম্ভু চন্দ্রকে আর এক চিঠিপত্রে জানান, - "বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের প্রথম সৎকার্য করিতে পারিব ইহার সম্ভাবনা নেই "।
বিদ্যাসাগরের এক সংস্কার ছিল "বিধবা বিবাহ" ও "কলিন প্রথা" -র বিরুদ্ধে। সামাজিক এই বহু বিবাহের নামে কুপ্রথা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি তার পুস্তিকাতেও লেখেন, - "বহু বিবাহ প্রচলিত থাকাতে অশ্বেষ হিন্দু সমাজের অনির্দিষ্ট ঘটেছিল। সহস্র সহস্র বিবাহের নারী যন্ত্রনা বোধ করিতেছে এটাই তিনি প্রমাণ করেছিলেন"।
বহু বিবাহ ছাড়া বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহ রোধ করতে প্রয়াসী হন। তার এই প্রয়াসের ফলশ্রুতি হিসেবে 1860 সালে একটি আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিয়ের বয়স "দশবছর" ধার্য করেন। দৈনিক সমাচার 'চন্দ্রিকায়' বাল্যবিবাহ বন্দ করার প্রয়াসের বিরোধিতা করে লিখেছেন "একমাত্র ভারতীয় নারীর কর্তব্য বিবাহের পর তার স্বামীর সঙ্গে একত্রিভূত হওয়া"। "অল্প বয়সী মেয়েদের বিবাহ না হলে স্বামী - স্ত্রী মধ্যে সঠিক বোঝাপড়া ও সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে না"।
এছাড়া বিদ্যাসাগর মেয়েদের জন্য বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। যাতে করে মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায় স্বাধীনভাবে এবং তাদের জীবনকে আলোকিত করতে পারে।
যাইহোক উপরিক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় শত বাধা বিপত্তি সত্বেও বাংলার এই মহামানব নিজেকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কখনও পিছিয়ে যাননি। প্রবল সাহসের সাথে বাংলা তথা ভারতের সমাজের সংস্কার করার তিনি চেষ্টা করেন এবং প্রতিক্ষেত্রেই তিনি জয়লাভ করেন।
............. সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
👉 তথ্যসূত্র
- সুমিত সরকার, "আধুনিক ভারত"
- শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, "পলাশি থেকে পার্টিশন"
- Ishita Banerjee-Dube, "A History of Modern India".
✍️সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন🙏।