বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের এক বীর যোদ্ধা ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। তিনি বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের রণকৌশল সহ ধর্মীয় সহনশীলতা প্রতিভা পূন্য শাসক সাহিত্য সংস্কৃতি পণ্য একজন শাসক ছিলেন। মোগল সম্রাট আকবর যেমন শক্তিশালী ছিলেন তেমনি তিনি মজবুতই ছিলেন। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যকে মুঘল সম্রাট আকবর তার প্রতিভা ধর্মীয় সহনশীল তার জনকৌশল দিয়ে যথেষ্ট ভাবে গড়ে তুলেছিলেন।
মুঘল সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন পিতা এবং হামিদা বানু ছিলেন মাতা মুঘল সম্রাট আকবরের। মুঘল সম্রাট আকবর সিন্ধু প্রদেশের অমরকোটে (বর্তমান পাকিস্তানের রয়েছে) ১৫৪২ সালে সম্রাট আকবর জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৫১ সালে গজনী নামক স্থানে সম্রাট আকবর শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন, পরবর্তীতে ১৫৫৬ সালে আকবরের পিতা মোগল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৪ বছর বয়সে সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহন করেন। বৈরাম খান মোগল সম্রাট আকবরের অভিভাবক হিসেবে মোগল রাজ্য দেখাশোনা করতেন। কাটা পায়ের আর বাহুবলির মতো বৈরাম খান ও মোগল সম্রাট আকবরের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। ১৫৬২ সালে রাজপুত ঘারানার রাজা ভার মানে জ্যৈষ্ঠ কন্যা, যোধা বায়ু সঙ্গে মোগল সম্রাট আকবরের বিবাহ হয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্রSource- wikipedia (check here) |
👉মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন প্রতিভা :-
মোগল বা মুঘল সম্রাট আকবর শুধুমাত্র যুদ্ধ পরিকল্পনা, যুদ্ধ প্রতিভা ও যুদ্ধ জয়ে পারদর্শী ছিলেন না মোগল সম্রাট আকবরের তো সংগঠন শক্তির পরিচয় ও প্রতিভায় পারদর্শী ছিলেন। মোগল সম্রাট আকবরের বিজিত বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের কৃতিত্ব যথেষ্ট প্রশংসানীয় ছিল। তাই ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন "ভারতীয় ভিত্তির উপর আরবীয় পারসিক ভাবধারার নিয়ন্ত্রণ"।
👉মুঘল সম্রাট আকবরের ক্ষমতা :-
বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ছিলেন মোগল সম্রাট স্বয়ং নিজেয়। মোগল সম্রাট আকবরের ক্ষমতা ছিল সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। বেসামরিক এবং সামরিক সমস্ত বিভাগের সর্বোচ্চ অধিনায়ক ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। মুঘল সম্রাট আকবর দায়িত্বহীনভাবে দেশ শাসন করতেন না তিনি শুধু প্রজাদের কল্যাণ সাধনের কামনার জন্যই শাসন নীতি নির্ধারণ করতেন। তবে মোগল সম্রাট আকবর স্বৈরাচারীও ছিলেন। মোগল সম্রাট আকবর জ্ঞান গুণের শহিত পরামর্শ সহকারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। প্রতিদিন তিনবার মোগল সম্রাট আকবর রাজসভার অধিবেশনে উপবেশন করতেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের প্রজাদের জন্য। মোগল সম্রাট আকবর কেবল একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন না তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুসংগঠক তিনি তার শাসন ব্যবস্থার জন্য ভারতের ইতিহাসের চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
👉মুঘল সম্রাট আকবরের প্রশাসন ব্যবস্থা :-
মোগল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা :- মোগল সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়েও মহামতি আকবর স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। মোগল সম্রাট আকবর মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শক্রমে কাজকর্ম করতেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসন যন্ত্র দেখাশোনার জন্য মোগল সম্রাট আকবর কতগুলি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ওপর নির্ভর করতেন। যেমন ভকিল বা প্রধানমন্ত্রী, দেওয়ান বা রাজস্ব মন্ত্রী, মিরবকসি বা সমর মন্ত্রী, মিরসামান বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কাজি - উল -কাজাৎ বা প্রধান বিচারপতি। এছাড়া ছিলেন আজ-ই-মোবারক গোসলখানা বা সম্রাটের সেক্রেটারি প্রমুখ।
👉মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা :-
মোগল সাম্রাজ্যের শাসন কাজে সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৫ টি সুবায় বিভক্ত করেন। সুবাগুলি সরকার এবং পরগণায় বিভক্ত ছিল। মুঘল শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর ছিল গ্রাম। সুপার যিনি দেখাশোনা করতেন তাকে বলা হতো মোগল সাম্রাজ্যের সুবেদার। আর সুবার প্রধান সেনাপতিকে বলা হতো মোগল সাম্রাজ্যের শিপাহশালার। মোগল সাম্রাজ্যের সুবার অধীনস্থ রাজকর্মচারীরা ছিলেন দেওয়ান, কাজী, হাকিম, ওয়াকিয়ানবিশ, আমিন প্রভৃতি। মোগল সাম্রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা দেখাশোনার ভার ছিল ফৌজদারদের হাতে। এবং মোগল সাম্রাজ্যের গ্রাম দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল কানুনগো, পাটোয়ারী মুকাদ্দম প্রভৃতি শ্রেণী রাজকর্মচারী। তাছাড়াও মোগল সম্রাট আকবর ভারত বর্ষে প্রথম মনসবদারী প্রথা চালু করেন তার এলাকায় স্থানীয়ভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রতি নজর রাখতে না।
👉মনসবদারি প্রথা :-
মুঘল শাসনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারী প্রথা। ১৫৭১ সালে মোগল সম্রাট আকবর এই ব্যবস্থা চালু করেন। মনসব কথার অর্থ "পদ মর্যাদা"। মোগল সম্রাট আকবর জায়গীরদারী প্রথা তুলে দিয়ে মনসবদারী প্রথা চালু করেন। জায়গীরদারদের জায়গীরের পরিবর্তে মোগল সম্রাট আকবর নগদ বেতনের ব্যবস্থা করেন। মোগল সম্রাট আকবর নানা পদমর্যাদা বিশিষ্ট মনসবদার নিয়োগ করতেন। ১০ থেকে ১০ হাজার পদ মর্যাদা সম্পন্ন এরূপ মনসবদারেদের পরিচয় পাওয়া যেত মোগল সাম্রাজ্যে। তবে সাধারণ উচ্চ পদস্থ মনসবদারী পদ পেতেন মোগল সম্রাট আকবরের নিকট আত্মীয়গণ। নিম্ন শ্রেণীর মনসবদারদের বলা হতো রেজিন্দর এবং উচ্চপদস্থদের বলা হত ওমরাহ। মানসিংহ ছিলেন ৭ হাজারি মনসবদার। যে সমস্ত মনসবদার জায়গীর ভোগ করতেন তাদের বলা হত তনখা জায়গীর। বংশ-পরম্পরা মূলক মনসবদারদের বলা হত ওয়াতন জায়গীর। ১৫৯৭ সালে তিনি মনসবদারী প্রথাই জাট ও শাওয়ার এই দুই ধরনের পদ সৃষ্টি করেন। শাওয়ার পদ তিন প্রকার ছিল যথা - এক আসপা, দুই আসপা, শি আসপা। এছাড়া ছিল আমির ও আমির - ই - উমদি নামক মনসবদার। মোগল সম্রাট আকবর তার ইচ্ছামতো মনসবদারদের নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি বা বরখাস্ত করতেন।
👉মুঘল আকবরের রাজপুত নীতি :-
দূরদর্শী আকবর শক্তিশালী রাজপুতদের সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষে রাস্তায় না গিয়ে মিত্রতা নীতি গ্রহণ করেন মোগল সম্রাট আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বাধীনচেতা রাজপুতদের সহযোগিতা করা দরকার যদি ভারতবর্ষে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
👉বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন :-
১৫৬২ সালে রাজা বিহারী মলের কন্যাযোদ্ধা ভাইকে বিবাহ করেন মোগল সম্রাট আকবর। পরবর্তীতে মোগল সম্রাট আকবর বিকানির এ রাজকন্যাকে বিবাহ করেন এবং মোগল সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিমের বিবাহ দেন ভগবান দাসের কন্যা মান ভাইয়ের সঙ্গে।
👉মর্যাদাবান :-
রাজদরবারে রাজপুতদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন মোগল সম্রাট আকবর। মোগল সম্রাট আকবর উপযুক্ত সম্মান জ্ঞাপন করেন ভগবান দাস ও তার পুত্র মানসিংহকে। অর্ধেকের বেশি রাজপুত সৈন্য নিয়োগ করেন মোগল সম্রাট আকবর তার মোগল সেনাবাহিনীতে।
👉ধর্মীয় উদারতা :-
ধর্ম পালনে অবাধ স্বাধীনতা দেন রাজপুতদের মোগল সম্রাট আকবর। মোগল সম্রাট আকবর হস্তক্ষেপ করেননি কখনো মন্দির নির্মাণ ও ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষেত্রে। এমনকি মোগল সম্রাট আকবর রাজপুতদের হোলি উৎসবের অংশগ্রহণ করেন।
👉মুঘল সম্রাট আকবরের যুদ্ধনীতি :-
রাজপুত রাজারা মোগল সম্রাট আকবরের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করলেও যুদ্ধের দ্বারা মেবার, রণথম্বর, জয়সলমির ও মারয়াড়ের রাজারা মোগলদের অধীনতা স্বীকার করেন। ১৫৬৭ সালে চিতোরের পতন হয় এবং ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ সম্রাটের সেনাপতি মানসিংহের নিকট পরাজিত হন।
👉মুঘল সম্রাট আকবরের কৃতিত্ব :-
মোগল সম্রাট আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের মসনদে বসেন। পরবর্তীতে মোগল সম্রাট আকবর মোগল সাম্রাজ্যকে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। দিল্লি জয় : পনেরশো ছাপ্পান্ন খ্রিস্টাব্দে আদিল শাহের সেনাপতি হিমুকে পানিপথে দ্বিতীয় যুদ্ধে মোগল সম্রাট আকবরকে পরাজিত করেন। এবং দিল্লি ও আমরা দখল করে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন। মালব : ১৫০০-৬১ সালে মোগল সম্রাট আকবর উত্তর ভারতের মানব জয় করেন মানব অধিপতি রাজবাহাদুর এর কাছে পরাজিত হন। গন্ডোয়ানা জয় : ১৫৬৪ সালে গন্ধ আনার রানী দুর্গাবতী বিশাল মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্রমে যুদ্ধে করেও পরাজিত হন। তিনি বিশাল মোগল সৈন্যর হাতে আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করেন। ফলে গন্ধ আনারাজ্য মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজপুতানা জয়: মোগল সম্রাট আকবর ১৫৬৭ সালে চিতোর এবং পরে রণথম্বর, জয়সলমির, মারওয়াড় জয় করেন। গুজরাট জয়: ১৫৭২ সালে বিশাল মোগল বাহিনী গুজরাট অভিযান জয় করে গুজরাটকে মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত করে।
✍️মূল্যায়ন :-
উপরিক্ত আলোচনা অনুসারে বর্ণনা করা যায় যে, মোগল সম্রাট আকবর সরবা সেবা সঙ্গে সঙ্গে ৪৫ টি বছর অতিবাহিত করেছিলেন যুদ্ধ অভিযানের মধ্য দিয়ে এবং মোগল সম্রাট আকবরের আমলে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। বিশাল মোগল সম্রাট আকবর ভারতবর্ষে প্রথম মনসবদারি প্রথা চালু করেন এই মনসবদারগণ তার এলাকায় স্থানীয়ভাবে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি নজরও রাখতেন। মোগল সম্রাট আকবরের রাজনীতিকে রাজপুত জাতির প্রতি তোষণনীতি বলে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সম্রাটের রাজপুত নীতি বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি যে মজবুত করেছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------