নুরজাহান শব্দের মানে হলো জগতের আলো। নুরজাহান ছিলেন পারস্যের মির্জা গিয়াজ বেগের কন্যা। নুরজাহান মেহেরুন্নেসা নামেও পরিচিত। মির্জা গিয়াস বেগ ভারতে আসার পর শেখ মামুদ নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ব্যক্তি সঙ্গে দেখা হয় এবং শেখ মামুদ নামে সেই ব্যক্তিটির সাহায্যে গিয়াস বেগ মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে চাকরি পেয়েছিলেন। সেখানে যুবরাজ সেলিম তথা জাহাঙ্গীর মুঘল সম্রাট আকবরের পুত্র গিয়াস বেগের পুত্রী মেহেরুন্নেসার অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন।
নুরজাহানের এক প্রতিকৃতি ছবির, source- click here |
👉জাহাঙ্গীর ও নুরজাহানের প্রেম কাহিনী
এক সময় মোগল সম্রাট আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম তথা জাহাঙ্গীর নুরজাহানের প্রেমে আকুল ছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পরে পরেই ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ সেলিম তথা জাহাঙ্গীর আলিকুলি বেগকে হত্যা করেন এবং পারস্যের মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা নুরজাহান তথা মেহেরুন নেসাকে বিবাহ করেন ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিম তথা জাহাঙ্গীর এবং তাকে প্রধান মহিষীর মর্যাদাও দেন।
👉নুরজাহানের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র
নুরজাহান রূপবতী কল্যাণময়ী অধিকারিনী ছিল প্রশংসনীয়। নুরজাহানের চরিত্রে সাংস্কৃতিক চেতনা, পারসিক শিক্ষা, রুচিবোধ ও অভিজাত্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিল। চিত্রশিল্পে অপূর্ব ছিল নুরজাহানের দক্ষতা। মানবিক গুণাবলীর বিপুল সমাবেশ ঘটেছিল নুরজাহানের চরিত্রে। কোমল ও দয়াপ্রবণ ছিল নুরজাহানের হৃদয়। নুরজাহান বেগমের আন্তরিকতা ছিল গভীর, দুর্বল ও অসহায় কষ্ট নিবারণ কাজে।
👉নুরজাহানের রাজনৈতিক দক্ষতা
নুরজাহান মুঘল রাজনীতিতে প্রায় সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যখন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্ব শেষ হয়েছিল। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সজ্ঞানে তার প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে নুরজাহানকে প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর সমস্ত সরকারি ফরমানের পাশাপাশি নুরজাহান বাদশা বেগমের নামটি উল্লেখিত করার পরামর্শ দিতেন। এমনকি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নুরজাহানেরও রাজকীয় স্বর্ণ মুদ্রায় জাহাঙ্গীর ও নুরজাহানের উভয়ই ছবি খোদিত করে ছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে নুরজাহান বেগম অনন্ত দক্ষ ও বিচক্ষণ ছিলেন। যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ে এর সমাধান নুরজাহান বেগম খুব সহজেই করতে পারতেন।
👉নুরজাহানের রাজনৈতিক সুযোগ গ্রহণ
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান ব্যাপকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যে প্রশাসন বিস্তার করেছিলেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান বেগমের হাতেই নিয়ন্ত্রণ হতে থাকে বিশাল মুঘল প্রশাসন। নুরজাহানের পিতা মির্জা গিয়া বেগ এবং নুরজাহানের দুই ভ্রাতা ইদমত খাঁ ও আসফ খা নুরজাহান বেগমের সহায়তায় বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের রাজদরবারে উচ্চ পদ লাভ করেছিলেন।
👉নুরজাহান চক্রের গঠন
যখন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তখন সেই সুযোগ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নুরজাহান চক্রান্ত করে একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন যা নুরজাহান চক্র নামে পরিচিত। বিশাল মুঘল রাজনীতিতে এই নুরজাহান চক্রের একাধিকপত্য শুরু হয় যখন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্রমে ক্রমে আমোদ প্রমোদে মধ্যে মত্ত হয়ে পড়েছিলেন। নুরজাহান বেগমের পিতা মীর্জ গিয়াস বেগ এবং নুরজাহান বেগমের ভাই আসফ খা ও যুবরাজ খুররম নুরজাহান বেগমের নেতৃত্বে গঠিত হয়ে এই নুরজাহান চক্রের সদস্যের মধ্যে ছিলেন।
👉নুরজাহান চক্রের উদ্যোগ
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান বেগম রাজনীতি ও প্রশাসন কাজে নুরজাহান চক্রের একাধিটত্য শুরু করেন যখন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্রমে ক্রমে আমোত প্রমোদ ও মদ্যপানে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় সিংহাসন পশ্চাতের শক্তি হিসেবে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান বেগম। ডঃ নুরুল হাসান "নুরজাহান বেগমের এই নুরজাহান চক্র এর বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন"।
👉নুরজাহান চক্রের পরিণতি
১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর অসুস্থতা ও দূর্বলতার সুযোগে নুরজাহান বেগম তার প্রথম পক্ষের লাডলি বেগম কন্যাকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠপুত্র শাহরিয়ার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ফলস্বরূপ খুররম বেরিয়ে যান এই নুরজাহান চক্র থেকে। পরিশেষে যুবরাজ খুররম নুরজাহানকে ক্ষমতা চ্যুত করে সিংহাসনে বসেন।
👉নুরজাহান চক্রের পতন
মোহাম্মদ খাকে দিল্লি রাজনীতি থেকে সরে যেতে বলায় মহাবৎ খা বিদ্রোহী হয়ে বন্দী করেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে এবং সংকট সৃষ্টি করেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে মুক্ত করেন নুরজাহান বেগম অতি দক্ষতার সঙ্গে বিদ্রোহ দমন করে। এইসব ঘটনার পরবর্তী কালে খুব অল্পদিনের মধ্যে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান জজাহাঙ্গীর এবং চক্রান্তকারী নুরজাহানের পতন ঘটে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।
👉নুরজাহানের মৃত্যু
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর পরবর্তীতে নুরজাহান বেগম মোগল সাম্রাজ্যের হারেমে অন্দরমহলে তার শেষ জীবন অতিবাহিত হয় যখন নতুন মোগল সম্রাট শাজাহান ছিলেন। অবশেষে নুরজাহান বেগম ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
✍️মূল্যায়ন
উপরিক্ত আলোচনা অনুসারে বিশ্লেষণ করা যায় যে, পরবর্তীতে নুরজাহানকে বাকি জীবন গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয় যখন মোগল সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট শাহজাহান হন। তবে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে শোভনীয় ছিল নুরজাহান রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। জাহাঙ্গীরের সমাধির পাশেই ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে নুরজাহান বেগমের মৃত্যু হলে তাকে দাফন করা হয়। ডঃ ত্রিপাঠী বলেছেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনে অশুভ শক্তি হিসেবে দেখা দেননি জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান বেগম বরং রক্ষাকারীর দেবদূতের মতই জাহাঙ্গীরের পাশে ছিলেন জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী নুরজাহান বেগম।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------