মুঘল আফগান দ্বন্দ্ব

আফগানের বিরোধিতা প্রধান বাধা ছিল ভারত মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পথে। মুঘলদের সামনে প্রাচীর হয়ে তুলে দাঁড়াই ভারতের আফগানরা এবং যোদ্ধা শ্রেণী রাজপুত শাসক শ্রেণীগণ। ভারতের মুঘলদের চিন্তার কারণ ছিল আফগানের বিরোধিতা। এইজন্য আফগানদের সাথে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় প্রাথমিক পূর্বে মুঘল সম্রাট বাবরকে। পরবর্তীকালে আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে মুঘল সম্রাট বাবরের পুত্র সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে।


মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র, Source- (check here



দাম্ভিক ও উদ্ধত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদী। ফলস্বরপ, ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করে আফগান অভিজাতরা ইব্রাহিম লোদীকে। মুঘল সম্রাট বাবরকে ভারত আক্রমণের প্ররোচনা দেন পাঞ্জাবের আফগান শাসক দৌলত খাঁ। মোগল সম্রাট বাবর ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণ করেন। কিন্তু মোগল সম্রাট বাবরের মতো বিরোধ দেখাতেই দৌলত খাঁর সঙ্গে এবং মোগল সম্রাট বাবরকে কাবুলে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতো সময়ে মোগল সম্রাট বাবর পুনরায় ভারতে অভিযান শুরু করেন। মুঘল সম্রাট বাবর পাঞ্জাব দখল করেন এবং দৌলত খাঁ মুঘল সম্রাট বাবর এর কাছে পরাজিত হন। অতঃপর দিল্লির দিকে মোগল বাহিনী অগ্রসর হয়। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল আফগান বাহিনীর যুদ্ধে লিপ্ত হয় দিল্লির অদূরে পানিপথের প্রান্তরে। মুঘল সম্রাট বাবর মাত্র ১২ হাজার সৈন্যের সাহায্যে বিশাল আফগান বাহিনীকে কুশলী নেতৃত্বে দ্বারা পরাজিত করেন। যুদ্ধে নিহত হলেন ইব্রাহিম লোদী। ভারত ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। মুঘল বংশে শাসনের সূচনা ঘটে তুর্কি আফগানের পরিবর্তে। 



মুঘল সম্রাট বাবর রাজপুত সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন মোগল আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা চূড়ান্ত হওয়ার মাঝ পথে। সুলতানি সাম্রাজ্যের ধ্বংসের স্তুপে স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তুলতে মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ সচেষ্ট ছিলেন। কিছু রাজ্যের রাজপুত রাজাদের সংবদ্ধ করেন। উদাহরণস্বর - অম্বর, আজমির, চান্দেরী, গোয়ালিয়র, মাড়োয়ার ইত্যাদি রাজ্যগুলি সংবদ্ধ করেন। মামুদ লোদি আফগান দলপতি মোগল রাজপুতদের সঙ্গে জোট দেন। মোগল সম্রাট বাবর ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করে খানুয়ার প্রান্তরে সম্মিলিত রাজপুতদের এবং সামরিক দক্ষতার পরিচয় মুঘল সম্রাট বাবর আবার ফিরিয়ে পান। খানুয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দৃঢ় হয়  ভারতের রাষ্ট্র স্থাপনের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিলোপ হয়।



মুঘল সম্রাট বাবর পুনরায় আফগানের মুখোমুখি হন রাজপুতদের শক্তির ধ্বংস করার পর। আফগান শক্তি নিঃশেষিত হয়নি পানিপথের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরেও। ইব্রাহিম লোদী ভ্রাতা মামুদ লোদি আফগান সরদার ঐক্যবদ্ধ করে মোগল সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মাহমুদ লোদিকে বাংলার শাসক নুসরত শাহ। মোগল সম্রাট বাবর কোন ভয় কোন কিছু না ভেবে চুনার, এলাহাবাদ, বারাণসী নিজের দখলে আনেন। মোঘল সম্রাট বাবর পার্টনার উত্তরে গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদী সংযোগস্থলে আফগান বাহিনীর মুখোমুখি হন। এক্ষেত্রে আফগানের পরাজিত ও বিধ্বস্ত করেন দক্ষ সেনাপতি বাবর। দক্ষ সেনাপতি বাবরের অনুগত নসরাৎ শাহ সহ বহু আফগান সর্দারেরা মেনে নেন। পানিপথের যুদ্ধের ফলস্বরূপ উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিনে গোয়ালির এবং পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত স্থাপিত হয় মুঘল কর্তৃত্ব। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে ঘর্ঘরার যুদ্ধের পর মোগল সম্রাট বাবর অসুস্থ হয়ে যান এবং ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে ডিসেম্বর মঙ্গল সম্রাট বাবর মৃত্যুবরণ করেন। 



মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসনে বসেন। মোগলদের বিরুদ্ধে আফগানরা নতুন উদ্যমে সংবদ্ধ হয়। মাহমুদ লোদি বিহারের উদীয়মান আফগান যুবক বাংলার আফগান শাসক গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এইসব কাজে বেশি দক্ষ ও উদ্যোগী ছিলেন। সম্রাট বাবর এর হাত দ্বারা পরাজিত হওয়ার পরেও হাল ছেড়ে দেননি আফগান নেতা মাহমুদ লোদি। আফগান নেতা মামুদলোদী দিল্লি দখলের পরিকল্পনা সংগঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। দিল্লি দখল করতে উদগ্রীব ছিলেন গুজরাটের আফগান শাসক বাহাদুর শাহ। অন্যদিকে মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে সংকার কারণ বিহারের উদয়ীমান আফগান নেতা শেরখার ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েও দাঁড়িয়েছিল। এমন অবস্থায় আফগানদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মোগল সম্রাট হুমায়ুন। প্রথমে মোগল সম্রাট হুমায়ুন আক্রমণ করেন বুন্দেল খন্ডের কালিংজোর দুর্গ। বুন্দেল খন্ডের কালিংজোর দুর্গ আফগানের প্রতাপ রুদ্র সহানুভূতিশীলের প্রতি হিন্দু অধিপতি ছিলেন। বিপুল অর্থ বুন্দেল খন্ডের কালিংজোর দুর্গো থেকে আদায় করেছিলেন। তারপর মামুদ লোদী ও তার আফগান সহযোগীদের মোগল সম্রাট হুমায়ুন দৌড়ার যুদ্ধে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করেন। এরপর মোগল সম্রাট হুমায়ুন চুনার দুর্গ অপরোধ করেন যা আফগান বীরখার অধীনস্থ ছিল।




পরবর্তীতে যখন শেরখা মৌখিক অনুগত্য স্বীকার করেন তখন চার মাস পর অধীনস্থ চুনার দুর্গ মুঘল সম্রাট হুমায়ুনঅবরোধ তুলে নেন। ততঃপর মোগল সম্রাট হুমায়ুন যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে। সম্রাট হুমায়ুন ও সুলতান বাহাদুর শাহের যুদ্ধে লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই শেরখা এবং নিজশক্তি পূর্ব ভারতে বৃদ্ধি করতে থাকেন। পরবর্তীতে বেশ কিছু এলাকা বাংলার দখল করেন এবং ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে অবরোধ করেন রাজধানী গৌড়। সম্রাট হুমায়ুন শংকিত বোধ করেন কারণ শেরখার ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় এবং চুনার দুর্গ সম্রাট হুমায়ুন অবরোধ করেন পরবর্তীতে গৌড়ে শেরখা পালিয়ে যান। সম্রাট হুমায়ুন ৬ মাস পরে যখন গৌড়ে যান সেই সময় গৌর থেকে শেরখা চলে যায় এবং যৌনপুর ও কনৌজ শেরখা দখল করে নেন। ফলে নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে ওঠে দিল্লির আগ্রার দ্রুত সম্রাট হুমায়ুন দিল্লির প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ইতিমধ্যে যখন সম্রাট হুমায়ুন বক্সারের নিকট চৌসা গ্রামে পৌঁছায় তখন সম্রাট হুমায়ুনের পথে শেরখা অবরোধ করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুন পরাজিত হয় ও সম্রাট হুমায়ুন বিধস্তত হন। কোনোক্রমভাবে সম্রাট হুমায়ুন দিল্লির আগ্রায় পালিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। বিজয় অর্জনের ফলে শেরখার বাংলা, বিহার, যৌনপুর রাজ্যভুক্ত করেন। শেরখার শাহ উপাধি চৌসার যুদ্ধের পর গ্রহণ করেন। পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করেন সম্রাট হুমায়ুন এবং হুমায়ুন দিল্লীর মসনদের বৈধ দাবিদার বলে নিজেকে ঘোষণা করেন। পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করে হুমায়ুন শেরশাহকে এক বছরের মধ্যে আক্রমণ করেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে আবার হুমায়ুন বিল্বগ্রাম বা কৌনজের যুদ্ধে পরাজিত হন। শেরশাহের আগ্রা ও দিল্লি হস্তগত হয় এবং পারস্যে পালিয়ে যেতে হুমায়ুন বাধ্য হয়। সিংহাসনে এইভাবে মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের পরিণতিতে আফগান বীরশাহের অধিষ্ঠান ঘটে তারপর পাঁচ বছর পর হুমায়ুন রাজত্ব করেন। 



পাঁচ বছর রাজত্ব করার বেশ কিছুদিন পরে শেরশাহের মৃত্যু হয়। শেরলাহের মৃত্যুর পর বিশৃঙ্খলা রাজ্যে দেখা দেয়। ফলে রাজ্য দুর্বল আত্মকলহে ক্ষমতা হ্রাস করেন। তারপর এই সময়ের সুযোগ নিয়ে শেরশাহের আত্মীয়দের একজন যার নাম মুরারিজ খাঁ দিল্লির ক্ষমতা ষড়যন্ত্র করে দখল করেন। 'মোঃ আদিল শাহ' এই উপাধিটি মুরারিজ খা নেন। তিনি শাসক হিসেবে ও অপদার্থ ছিলেন। এই সুযোগ নিয়ে সর্বাসেবা হয়ে ওঠেন তার হিন্দু মন্ত্রী হিমু, দিল্লি, আগ্রা, সিন্দু ও গঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেন আফগান সরদার ইব্রাহিম খাঁ সিকান্দার শূর প্রমুখ। এই বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও আগ্রা পুনর্দখল করেন রাজ্য চ্যুত মুঘল শাসক হুমায়ুন পারস্যের শাহ তহমাস্পের সহায়তায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হুমায়ুন হঠাৎ করে পরের বছরেই মারা যান। 



যখন আকবর সিংহাসন আরোহণের সময় মাত্র ১৩ বছরের কিশোর ছিলেন আকবর। তাই মোগলদের পাঞ্জাবের শাসনকর্তা বৈরামখা ও বিশ্বস্ত অনুচর নিযুক্ত হন। এই সময় আগ্রা, দিল্লি ও পাঞ্জাব এই তিনটি ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ ছিল মুঘল সাম্রাজ্য। পূর্ব ভারতের শেরশাহের আত্মীয় আহমদ আদিল শাহ প্রভুত শক্তি সঞ্চয় করে স্বপ্ন দেখেছিলেন দিল্লি দখলের আদিলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যু। সসৈন্যের অগ্রসর হয়ে আগ্রা দিল্লি ও আদিল শাহের মন্ত্রী হিমু জয় করেন এবং স্বাধীন রুপে নিজেকে ঘোষণা করেন। পাঞ্জাব সীমান্তে বিদ্রোহ দমনে কিশোর আকবর ব্যস্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে মোগল বাদশা বলে বৈরাম খা আকবরকে ঘোষণা করেন। হিমুর বিরুদ্ধে বৈরাম খাঁ ও আকবর সসৈন্যে অগ্রসর হন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আকবর দিল্লির পুনরুদ্ধার করেন হিমুকে পরাজিত ও নিহত করেন। 



✍️মন্তব্য :- 

পরিশেষে মন্তব্য করা যায় যে, মোগল আফগান দ্বন্দ্ব সমাপ্ত হয় এভাবে তিন দশক ধরে চলে সুদৃঢ় ও সাম্রাজ্য বিস্তারে পথ প্রশস্ত হয় ভারতের মুঘল শাসনের।

............ সমাপ্তি...........


✍️লেখিকা পরিচিতি

Muntaha Yasmin
নাম- Muntaha Yasmin
ইউনিভার্সিটি - University of gour banga


📖তথ্যসূত্র

  1. Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
  2. Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".

    📖সম্পর্কিত বিষয়

    সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।

           ------------🙏---------------


    নবীনতর পূর্বতন
    👉 আমাদের WhatsApp Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
        
      
      👉 আমাদের WhatsApp Channel- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
    
        👉 আমাদের Facebook Group- ক্লিক করুন 🙋‍♂️
      
    
    
      
    
       
      
      
        👉 আমাদের Facebook Page-ক্লিক করুন 🙋‍♂️
    
    
        👉আমাদের YouTube চ্যানেল - সাবস্ক্রাইব করুন 👍 
    
    
    
    
        
      
    
      
    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য

    
    

    টেলিগ্রামে যোগ দিন ... পরিবারের সদস্য


     


     




    
    

    👉নীচের ভিডিওটি ক্লিক করে জেনে নিন আমাদের ওয়েবসাইটের ইতিহাস এবং বিভিন্ন চাকুরী সম্পর্কিত পরিসেবাগুলি 📽️

    
    
    

    👉 জেনে আপনি আমাদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা 📖

    👉ক্লিক করুন 🌐