নিরস্তর যুদ্ধে দ্বারা আকবর হিমালয় থেকে নর্মদা নদী এবং হিন্দুকুশ থেকে ব্রাহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত এবং দক্ষিণের খান্দেশ, আহাম্মদনগর, বিদর্ভ প্রভৃতি রাজ্যের উপর মুঘলের সার্বভৌম কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন। আকবরের যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন দক্ষ সাহসী ও কৌশলী। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে যে তাদের সূচনা ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ও অসিরগর দুর্গ দখলের মধ্যে তার সমাপ্তি। যোদ্ধা হিসেবে তার সাফল্যের কাহিনী যেমন বহুল আলোচিত একটি বিষয় তেমনি রাজ্য জয়ের পশ্চাতে তার সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি ও ইতিহাস বহুল আলোচিত একটি ঘটনা।
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র, Source- (check here |
আকবরের রাজ্য বিস্তার নীতির প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত বর্তমান। আবুল ফজল লিখেছেন যে, "আকবরের রাজ্য জয়ের অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্থানীয় স্বৈরাচারী রাজাদের স্বার্থপর ও অনিয়ন্ত্রিত অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করে তাদের সুখ ও সমৃদ্ধির রাজ্যে স্থাপন করা।" ভন্ড নোয়ের লিখেছেন, "কেবল রাজ্যজয়ের নেশা আকবরকে যুদ্ধে প্রবর্তিত করেননি।" এদের মতে আকবর ছিলেন ভারতবর্ষের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। রাজ্য বিজয় নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী "আসমুদ্র হিমাচল" ব্যাপি ভারত সম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন জীবন ঘটানো।
কিন্তু কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন আকবরের রাজ্য জয়ের প্রেরণা এসেছিল মধ্যযুগীয় নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের ধারা থেকে। ড. জি. এন. শর্মা (G.N. Sharma) লিখেছেন, "Akbar was throughout his career a consistent imperialist." বিভারেজ আকবরকে বহুনিন্দিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসক ডালহৌসির থেকেও বড় সাম্রাজ্যবাদী বলে অভিহিত করে লিখেছেন। আকবর নিজেও মন্তব্য করেছেন যে, প্রতিবেশি রাজ্যের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায় হল আগেই তাদের আক্রমণ করা।
আকবরের রাজ্য জয়ের ধারা বিশ্লেষণ করলে দুটি বৈশিষ্ট্যের অবস্থান লক্ষ করা যায়। উন্মাদন বা নতুন ভূখণ্ড জয় করে প্দানত করে রাখার প্রবনতা আকবরের ছিল না। বহু রাজ্যের ক্ষেত্রে যুদ্ধের পরিবর্তে অধীনতামূলক বশ্যতা আদায়ের জন্য তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। রাজপুত রাজ্যসমূহ বা দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির দূত প্রেরণা করে তাদের আনুগত্য আদায়ের তার ত্রুটি ছিল না। বহু রাজপুত রাজ্য তার বশ্যতা স্বীকার করে শাসনের অধিকার ভোগ করতো। খান্দেশের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
একমাত্র যখন খান্দেশ বিরুদ্ধাচরণ করে, তখনই তিনি সেখানে অভিযান পাঠান। দ্বিতীয়ত নব অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রতি আকবর কোন রূপ অসম আচরণ করতেন না। আকবর অধিকৃত সমগ্র ভূখন্ডে এক শাসন, এক আইন ও এক মুদ্রা প্রচলিত ছিল। সমগ্র ভূখণ্ড শাসিত হতো একই পরিকাঠামোর দ্বারা। একটি শক্তিশালী সামরিক গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি জনসমষ্টির ওপর জঙ্গি শাসন কায়েম করার চেষ্টা তিনি করেননি। তিনি প্রকৃত অর্থে জাতির অভিভাবক হিসেবে জনসমষ্টির ওপর তার শাসন প্রসারিত করেছিলেন। তাই একজন নগ্ন ও অন্ত সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে আকবরকে চিত্রায়িত করা অসম্ভব।
অবশ্য আকবরের সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ মহৎ হলেও তার প্রয়োগ পদ্ধতি সর্বদা যুক্তি গ্রাহ্য ছিলনা। গান্ডুয়ানা রানী দুর্গতি কোনভাবেই মুঘলের বিরুদ্ধাচারণ করেন। অথচ কেবলমাত্র অর্থের লোভে মুঘল বাহিনী তার রাজ্য গ্রাস করে। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ "আকবর কর্তৃক এই আক্রমণকে যুক্তি বর্জিত নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ বলে অভিহিত করেছেন"।
বাগুনির বিবরণ থেকে জানা যায় "হলদিঘাটের যুদ্ধে বিজয়ের পর মুঘল সেনাপতি মানসিংহ আসফ খাঁ প্রমুখ মেবার রাজ্য লুন্ঠন করেননি বলে আকবর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং কিছুদিনের জন্য এই সব সেনাপতিদের দরবারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। এটা অবশ্য তার জিঘাংসমূলক মন আবৃত্তির একটা নিদর্শন।" যাইহোক দু একটি বিচ্যুতি দ্বারা আকবরের কর্তৃত্বকে মানান করা ঠিক না। আকবর সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ছিল বিচ্ছিন্নতা নয় ঐক্য, শোষণ নয় শাস্তি ও নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় রাজ্য নয় সুশাসন স্থাপন।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------