প্রাচীনকাল থেকে ভারতের শিল্পচর্চার ঐতিহ্য অব্যাহত আছে। কালের করালগ্রাসে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের প্রায় অধিকাংশ শিল্পকর্ম হারিয়ে গেছে। অতীতের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে কিছু ধ্বংসাবশেষ। পূর্ব ভারতের স্তুপ বিহার ইত্যাদি পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের কিছু কিছু ক্ষীয়মান নির্দশন থেকে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের ধারণা পাওয়া চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন যুগ ও আদি মধ্যযুগের সংযোগ কালে ভারত পরিভ্রমণরত চৈনিক পর্যটক ফাহিয়েন, হিউয়েন সাং প্রমুখ ভারতের শিল্পধারার যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, তখন ভারতে এবং বিশেষভাবে পূর্ব ভারতে বহু বিচিত্র ও কারুকার্য কচিত স্তূপ বিহার প্রসাদ মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ হয়েছিল।
👉 মন্দির
আদি মধ্যযুগের ভারতে স্থাপত্য শিল্পের কেন্দ্র ছিল মন্দির। গুপ্ত যুগে মন্দের স্থাপত্যের সূচনা হলেও বৈচিত্র ও অলংকরণের দিক থেকে আদি মধ্যেযুগের মন্দির শিল্প আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় মন্দির শিল্পে তিনটি ধারার উপস্থিত দেখা যায় - নাগর রীতি, দ্রাবিড় রীতি ও বেশরা রীতি। নগর শৈলীর মন্দিরগুলি সাধারণভাবে হয় বর্গাকৃতি। দ্রাবিড় শৈলী অষ্ট কোণ বিশিষ্ট এবং বেসরা শৈলীর বৈশিষ্ট্য বৃত্তাকার গৃহ। অবশ্য এই শৈলী কঠোরভাবে কোন বিশেষ এলাকায় অনুসৃত হতো এমন নয়। রাম চরিত্র গ্রন্থে রামাবতীকে ' ঈশ্বরের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র " বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সেই সকল মন্দিরের অধিকাংশই কেবল ধ্বংস স্তুপ এর মধ্যে জেগে আছে। আদি মধ্যযুগের মন্দির শিল্পে নিদর্শন হিসেবে সম্পূর্ণ বিহারের মধ্যবর্তী অঙ্গনের মন্দিরটি নজর পড়ে। ড. সরসি কুমার সরস্বতী, কে. এন, দীক্ষিত প্রমুখ এই মন্দিরটির বিশেষত্ব বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
👉স্তুপ
আদি মধ্যযুগে বাংলার শিল্পচর্চার মধ্যে স্থাপত্য, ভাস্কর, বিহার, স্তূপ, মন্দির ইত্যাদি সবই ছিল। 'রামচরিত্র' গ্রন্থের লেখক সন্ধ্যাকর নন্দি একাদশ শতকের বাংলায় প্রসাদ', মহাবিহার ও কাঞ্চন খচিত প্রাসাদ ও মন্দির ছিল বলে, গর্ববোধ করেছেন। কিন্তু তাদের সবই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চীন দেশীয় পর্যটকরা বাংলাদেশে অসংখ্য স্টূপের কথা বলেছেন। কিন্তু পাথরের অভাব হেতু ইতি নির্মিত এই সকল স্তূপের অধিকাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অষ্টম শতক ও পরবর্তীকালে স্তুপগুলির যে ধ্বংসাশেষ পাওয়া গেছে সেগুলি অধিকাংশ 'নিবেদক স্তূপ' এর পর্যায় ভুক্ত। বৌদ্ধ ধর্মাচরণে স্তূপ মন্দিরের মতোই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। জৈন্যরাও স্তূপ নির্মাণ করতেন। তবে বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ নির্মাণ করে 'বোধিসত্ত্ব'কে উপসর্গ করার মধ্যে পুন্যার্জনের ধারণা সম্পৃক্ত ছিল।
👉বিহার
স্তূপের মতো বিহার গুলির ধ্বংসাশেষ মাত্র পাওয়া যায়। ভিক্ষুদের বাসস্থান হিসেবে বিহার গুলির পরিকল্পনা ও নির্মাণ করা হতো। পরে এগুলি বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজশাহীর অন্তর্গত পাহাড়পুরে একটি বিশাল এলাকার বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত পালরাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকে এটি নির্মাণ করেছিলেন। 'সোমপুর মহাবিহার' নামে এটি বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে। সমকালীন একটি লেখতে এই বিহারকে জগতে নয়নের একমাত্র বিশ্রাম স্থল অর্থাৎ নয়ন মনোহর কীর্তি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
আদি মধ্যযুগের জৈন স্মৃতি সম্ভব গুলি ও স্থাপত্য শিল্পে নিদর্শন হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। স্মরণীয় এমন দুটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাতা ছিলেন গঙ্গ রাজা বা চতুর্থ রামমল্লোর মন্ত্রী চামুন্ডারায়। দুটি অবস্থান শ্রাবণ বেলগোলায়। এর একটি চামুন্ডারায় বসদি। চন্দ্র গিরি পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত এই সৌধের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হলো যথাক্রমে ৭০ ফুট ও ৩৬ ফুট। এটি নির্মিত হয় আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় সৌধটি প্রথম তীর্থঙ্করের পুত্র গোম্মতের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এবং এর নির্মাণকাল ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ।
আদি মধ্যযুগ তথা সার্বিকভাবে প্রাচীন ভারতীয় শিল্প স্থাপত্যের উচ্চ প্রশংসা দেশীয় এবং বিদেশি লেখকদের বর্ণনা থেকে জানা গেলেও তার অধিকাংশই চাক্ষুষ ভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ নেই। এই অপূর্ণতার কথা বলতে গিয়ে বাংলার প্রেক্ষিতে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার যে কথাগুলি লিখেছেন সেগুলি যথার্থ, তিনি লিখেছেন, -- " বাংলার স্থাপত্য শিল্পের কীর্তি আছে কিন্তু নির্দশন নেয়"। আর তাই এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে চর্চার সুযোগ ও সীমিত।
............. সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
👉তথ্যসূত্র 📖
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
👉সম্পর্কিত বিষয় 📖
- সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি (আরো পড়ুন)।
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- 1707 থেকে 1740 সালের মধ্যে মুঘল রাজ দরবারে বিভিন্ন দলগুলির উন্নতি এবং তাদের রাজনীতি (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন🙏 ।
. ......................