তুর্কিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ভারতের শিল্প ভাবনার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তুর্কির মত এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ায় এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সেখানকার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। নবম দশম শতকে আরবীয় ও পারসিক সভ্যতা উৎকর্ষ লাভ করেছিল। এই সকল অঞ্চলে ইসলামের সম্প্রসারণের ফলে স্থায়ী সভ্যতা সংস্কৃতি সাথে ইসলামের পরিচয় ও আত্তীয়করণ ঘটে। তাই তুর্কিরা যখন ভারতে আসে তখন শিল্প স্থাপত্য বিষয়ে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল।
তবে তুর্ক আফগান যুগে ভারতে যে স্থাপত্য কলার চর্চা শুরু হয় তা সম্পূর্ণ বহিরাগত বা ইসলামেও ছিল না। ভারতে বসবাস শুরু করার পর তুর্কিরা ভারতীয়দের সুপ্রাচীন ও সৌন্দর্যমন্ডিত শিল্প-স্থাপত্যের সাথে পরিচিত হয়। তুর্কিদের ওপর পারসিক শিল্পের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। আবার সুপ্রাচীনকাল থেকেই পারসিক ও ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতির মধ্যে মিল ছিল।
কারণ উভয় অঞ্চলের ছিল আর্য সংস্কৃতির উপস্থিতি। তাই তুর্কি শাসনকালে ভারতীয় শিল্প স্থাপত্য হিন্দু বা ভারতীয় ধারার সাথে ইসলামীয় ধারা সংমিশ্রণ ঘটে। উভয় ধারা সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত এদেশে এক সমৃদ্ধ শিল্পরীতির বিকাশ হয়। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্রের মতে, " এই সংমিশ্রণের কাজ চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে, বহু উন্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে। আত্তিকরণ ও সংঘাত দুটোই পাশাপাশি চলেছিল তবে স্থান ও কাল বিশেষ কোনটা বেশি বা কোনটা কম।"
তুর্কি যোদ্ধারা ঐতিহ্যশালী হিন্দু শিল্পে অপার্থিব সৌন্দর্য সুষম, কতৃত্ববান ভঙ্গিমা ও উদারতার সাথে ইসলামী ও স্থাপত্যে মানসিকতা ধর্ম ও ভৌগোলিক প্রয়োজনবোধ ইত্যাদি সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক নবতম শিল্পধারা জন্ম দেন। সুলতানি আমলের এই শিল্পধারা ইন্দো ইসলামী ও স্থাপত্য, ইন্দো ইসলামীয় স্থাপত্য বা পাঠানি স্থাপত্য নামে আখ্যায়িত হয়।
তুরকো আফগান শাসকদের আমলে ভারতীয় স্থাপত্যের রূপ বা অবয়ব এবং অলংকরণের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব আসে। ভারতীয় শিল্পী কারিগররা কংক্রিটের ব্যবহার জানতেন না। ভারতীয়দের স্থাপত্য কৌশল ছিল একের পর এক পাথর বসিয়ে দেয়াল তৈরি করা এবং শীর্ষ দেশের স্থাপন করে আচ্ছাদিত করা। কংক্রিট বা চুন বালি ও জলের মিশ্রণে আস্তর তৈরীর কৌশল ভারতীয়দের অজানা ছিল। ফলে প্রশস্তস্থানের উপর আচ্ছাদন সমন্বিত মন্দির বা প্রসার তৈরি করার কাজে উৎসাহ দেখানো হতো না।। তুর্কিদের সাথে সাথে ভারতীয় স্থাপত্যে খিলান ও গম্বুজ এর ব্যবহার শুরু হয়। হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপত্যে খিলান গম্বুজ এর অস্তিত্ব ছিল না।
সতীশ চন্দ্রের মতে, খিলান বা গম্বুজ এর ব্যবহার ভারতীয়দের অজানা ছিল না। কিন্তু খিলান তৈরীর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং মর্টার সম্পর্কে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল বলে হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপত্যে খিলান বা গম্বুজ ব্যবহার করত না। " মুসলমানরা পারস্যে এসে এই বিশিষ্ট স্থাপত্য ধারা সঙ্গে পরিচিত হয়। পারসিক স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল খিলান, গম্বুজ, তিন খিলান এবং গম্বুজের নিচে আট কোন বিশিষ্ট হই। গম্বুজ গুলি ছিল স্থাপতিদের আত্মবিশ্বাস আর মুসলমান শাসকদের দন্ডের প্রতীক।" চারকোণ বিশিষ্ট অট্টালিকার উপর নির্মিত গম্বুজ গুলির উচ্চতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
খিলান আর গম্বুজ ব্যবহারের ফলে বড় বড় উন্মুক্ত হল ঘর নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। প্রার্থনা কিংবা আলোচনা সভার পক্ষে এই ধরনের কক্ষ খুবই উপযোগী ছিল। কংক্রিটের অধিকতর ব্যবহারের ফলে পারসিক স্থাপত্যে বেশি জায়গা আচ্ছাদিত করা সম্ভব হয়েছিল। সুলতানি আমলে স্থাপত্য খিলান ও গম্বুজ এর পাশাপাশি প্রস্তর ফলক ও বিল পদ্ধতি ও ব্যবহার করা হতো।
ভারতীয়দের মত তুর্কিরা অলংকরণ প্রিয় ছিল। ইসলাম ধর্মের জীবিত প্রাণীর প্রতিকৃতি অন্ধন নিষিদ্ধ ছিল। তাই তুর্কিরা গৃহের শোভা বৃদ্ধির জন্য জ্যামিতিক আকৃতির লতা পাতায় জড়ানো নকশা এবং কোরআনের বাণী সম্মলিত লিপি ব্যবহার করত। এর সাথে তুর্কিরা কিছু সংশোধনসহ ভারতীয় অলংকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করে, যেমন -- স্বস্তিকা, পদ্মফুল, ঘন্টাাকৃতি ইত্যাদি। এইভাবে সুলতানি আমলের স্থাপত্য কর্মের নির্মাণ পদ্ধতি ও অলংকরণের ক্ষেত্রে এ দেশের প্রচলিত হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্প রীতি এবং মুসলমান বাহিত পারসিক শিল্পি রীতির অপূর্ব সম্মেলন দেখা যায়।
সুলতানি আমলে ইন্দু ইসলামী ও স্থাপত্যের উদ্ভব ও বিকাশ তিনটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল দাস ও খোলজি বংশীয় সুলতানদের আমলে সৃষ্ট লাহোর, দিল্লির ও আজমিদের স্থাপত্য কর্ম গুলি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল তুঘলকদের আমলে কাজগুলি যেগুলি পূর্বেকার কাজের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র এবং উন্নত ছিল। তুঘলকদের পতনের পর দিল্লি সুলতানি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যসঙ্গতি বিপন্ন হয়। এই সময়ে শুরু হয় তৃতীয় পর্যায়ের যখন প্রাদেশিক স্তরে এবং নব নব গঠিত স্বাধীন রাজ্যগুলিতে নতুনভাবে স্থাপত্যকর্ম বিকাশ লাভ করে।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------