ভারতের মুঘল শাসকরা চূড়ার স্বৈরাচারী মানসিকতাসম্পন্ন হলেও তাদের প্রতিভা এবং উদ্যম কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবিস্তার কিংবা দরবারী রাজনীতির টানাপোড়েনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ভরবারিকে শাণিত করে পাশাপাশি কলমে কালি ডরার কিংবা তুলিতে রং মাখানোর কাজও তাঁরা আন্তরিকতার সাথেই সম্পন্ন করেছিলেন।
Source- click here |
শিল্পীর কল্পনা এবং বাদশার মর্জি অনুযায়ী মুঘল চিত্রকলায় কখনো আঙ্গিক, কখনো চিত্রের অন্তনির্হিত সৌন্দর্য, থানা বিষয়বস্তুর প্রকাশকে প্রধান দেওয়া হয়েছে। বিষয়বস্তু হিসেবে কঠোর রাজনৈতিক ঘটনাবলী, যুদ্ধ-অভিযান, দরবারী রাজনীতি যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি গুরুত্ব পেয়েছে নৈসর্গিক চিত্র, পশু, পাখী কিংবা রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের কাহিনী।
মুঘল স্থাপত্যদির যেমন পারসিক শিল্পাদর্শ থেকে রস সংগ্রহ করে ভারতের মাটিতে ভারতীয় শিক্ষাদর্শের মিলনে নতুনভাবে অঙ্কুরিত হয়েছে, শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে আপন ধারায়, চিত্রকলাও তেমনি পারদিক চিত্ররমে সিক্ত হয়ে এবং পারসিক ও ভারতীয় রসের সমন্বয় এক স্বতন্ত্র চিত্রশৈলী হিসেবে নিজেকে প্রকাশিত করেছে।
পারসিক চিত্রের বৈশিষ্ট্য হল তার রেখা ও রঙ এবং ভারতের বৈশিষ্ট্য হল রঙের সুষম প্রয়োগ।" এডওয়ার্ডস গ্যারেটের মতে, মুঘল যুগের চিত্রকলায় এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব অঙ্গীভূতকরণ এবং সমন্বয়সাধন করা সম্ভব হয়েছে। এই সমন্বয়ের ফলে সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় চিত্রকলা।
মুঘল চিত্রকলার আর একটি বৈশিষ্ট্য বা নতুনত্ব হল ছোট পরিসরে চিত্রাঙ্কন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের ব্যাখ্যা-চিত্র অঙ্কন। সুলতানি আমলে বৃহৎ পরিসরে চিত্রাঙ্কন হলেও, ক্ষুদ্র চিত্র অন্তন-পদ্ধতি তখন অবহেলিত ছিল। যা মুঘল যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পধারা রূপে বিকশিত হয়েছিল।
মুঘল যুগে চিত্রকলাচর্চার প্রাথমিক পর্বে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কাজ হল "দপ্তান-ই-আমীর শীর্ষক চিত্রাবলি। এটি সাধারণভাবে হামজা নামা নামে বেশি পরিচিত। মীর সৈয়দ আলি এবং আব্দুস সামাদকৃত এই এ্যালবামে পারসিক চিত্রকলার প্রভাব ছিল বেশি। নামী ব্রাউন-এর মতে, 'তানসেনের আগমন' শীর্ষক চিত্রে পারসিক প্রভাবের পরিবর্তে মুঘল ও হিন্দু ধারার অপূর্ব সমন্বয়ের সূচনা ঘটে।
ষোড়শ শতকের শেষপর্বে কৃত সুন্দরতম চিত্রের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। "আকবরনামা' গ্রন্থের অলংকরণে। আকবরের আমলের চিত্রকরদের মধ্যে হিন্দু চিত্রকরের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দশবস্তু, বসাওন, কেশব, মুকুন্দ মহেশ প্রমুখ। আবুল ফজল তৎকালীন যে সতের জন অগ্রণী চিত্রকরের নামোল্লেখ করেদেন, তাদের মধ্যে অন্তত তের জন দিলেন হিন্দু। মুঘল চিত্রকলার বিকাশে এঁদের অবদান ছিল বিশাল।
আবুল ফজল এঁদের প্রশংসা করেছেন। দশবস্তু দিলেন জাতিতে কাহার (পালকিবাহক)। কিন্তু তাঁর প্রতিভা আকবরকে দারুণ মুগ্ধ করেছিল বলে আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, দশবন্ধের প্রতিভা বায়াজিদ কিংবা চৈনিক চিত্রকরদের তুলনায় কিছু কম ছিল না।
মুঘল সম্রাটদের মধ্যে জাহাঙ্গীর ছিলেন প্রকৃত অর্থেই চিত্রকলার সমঝদার, অনুরাগী; তার আমলে মুঘল চিত্রকলা সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়েছিল। নিজ আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন: "একাধিক চিত্রকরের আঁকা একই ধরনের বহু ছবি সামনে রাখলে আমি নিমেষে বলতে পারি কোনটির চিত্রকরকে"।
"এমনকি একাধিক শিল্পী দ্বারা একটিমাত্র ছবি অঙ্কন করলে আমি বলতে পারি, ছবির কোন অংশটি কোন চিত্রকর এঁকেছেন।" এই বক্তব্যে হয়তো অভিরঞ্জন আছে কিন্তু চিত্রকলার প্রতি যে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল, তা প্রমাণ করার পক্ষে এই স্বীকারোক্তি যথেষ্ট। জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রকলায় পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গচিত্রের পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তি, সত্ত গায়ক ও সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি অঙ্কন চিত্রকরদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
আহাসীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘলচিত্রকলার গৌরব-রশ্মিও অস্ত্রমিত হয়। পার্সী ব্রাউন-এর মতে শাহজাহান চিত্রকলার তুলনায় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রতি ছিলেন বেশি আগ্রহী। শাসনকালের সূচনাপর্বেও চিত্রকলার প্রতি তাঁর যেটুকু অনুরাগ দিল, পরবর্তীকালে তাও ফিকে হয়ে যায়। দরবারী চিত্রশিল্পীর সংখ্যা তিনি ভীষণভাবে কমিয়ে দেন। অন্যদিকে বহু শিল্পী ধনী ও অভিজাত ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রাক্ষনের কাজ শুরু করেন। ফলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একচেটিয়া কৃতিত্ব লোপ পায়।
প্রখর বাস্তববাদী এবং গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী ঔরঙ্গজেবের মতে, চিত্রাঙ্কন দিন বিলাসিতা এবং ইসলামের আদর্শবিরোধী। তিনি নিজহাতে বহু অমর চিত্রসৃষ্টিকে বিনষ্ট করেছেন। ফলে রাজ দরবারকে কেন্দ্র করে চিত্রশিল্প জাহাঙ্গীরের আমলের শেষ পর্ব থেকেই অবক্ষয়ের পথে চলে যেতে থাকে। তবে ধনী ব্যবসায়ী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাত ধরে মুঘল চিত্রকলার ঐতিহ্য নতুন নতুন দিকে প্রসারিত হতে থাকে।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------