সুলতানি আমলে হিন্দু ও মুসলমান শিরধারার সমন্বয়ে স্থাপত্য-সৃষ্টির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, মুঘপথে তা পরিপূর্ণতা অর্জন করে। মুঘল শাসকেরা রাজ্যজয় বা রাজ্যশাসনের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কৃতিত্বের অধিকারী। কিন্তু শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও তাঁদের কৃতিত্ব কালজয়ী সম্মানের দাবিদার। অধ্যাপক সরসী কুমার সরস্বতী লিখেছেন "মুঘল সম্রাটেরা ছিলেন। একান্তভাবে শিল্পীমনা ও প্রকৃতিপ্রেমিক এবং সমকালীন শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে তাদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে প্রতিভাত হয়েছে।"
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র, Source- (check here |
স্থাপত্য অনুশীলনের মাপকাঠিতে মুঘল স্থাপত্য কর্মে দু'টি ধাপ লক্ষ্য করা যায়— (১) সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে লাল বেলে পাথর সহযোগে স্থাপত্তা নির্মাণ, (২) সম্রাট শাহজাহানের আমলে শ্বেত মর্মর ও কৃষ্ণ মর্মরের সাথে মূল্যবান ধাতুর পেরাডুরা ও খোদিত নম্রতার সমন্বয়ে স্থাপতা নির্মাণ ।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এবং হুমায়ুনের আমনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সুকুমার কলাচর্চার পক্ষে সহায়ক না। প্রকৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্পকলার সমঝদার বাবরের ভারতবর্ষের শিরধারা সম্বন্ধে ধারণা ছিল খুব হীন। ভাগ্যের বিড়ম্বনা এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বারা বিরত হুমায়ুনের পক্ষে শিল্প স্থাপত্যের কাজে ইচ্ছানুযায়ী আত্মনিযোগ করা সম্ভব ছিল না। পারসিক শিল্প-ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ দিল, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শিল্পবোধের অভাবও ছিল না, তথাপি কোন স্থায়ী কীতি তিনি রেখে যেতে পারেননি।
সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের ফলে যেমন মুঘল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে এবং মুঘল রাজ্যের ঐতিহ্যের বৃদ্ধি ঘটে, তেমনি শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও নবযুগের ও নবজীবনের সূচনা হয়। আবুল ফজল লিখেছেন, সুনির্মাতা হিসেবে আকবরের ছিল সহজাত প্রতিভা। তাঁর আমলে স্থাপত্যে ইন্দো-পারসিক রীতির অপূর্ব সমন্বয় ও বিকাশ ঘটে। আকবরের স্থাপত্য-প্রতিভার সর্বোত্তম ও মহত্তম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ফতেপুর সিক্রির সৌথরাজিতে। এই মায়ানগরীতে সম্রাটের সমন্বয়ী কল্পনা পেয়েছে বাস্তব রূপ।
লেনেপুল (Lanepool) লিখেছেন: 'ভারতবর্ষের কোথাও এমন স্থান নেই, যা এই পরিত্যক্ত শহরের চেয়ে সুন্দর, অথচ যা এর চেয়ে বেদনা মনে উদ্রেগ করতে পারে। ফাদার মনসেরেট, চার্জ ফিচ প্রমুখ বিদেশী পর্যটকও এই জাদু-নগরীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত স্থাপত্য কর্মের প্রধান উপকরণ ছিল লাল বেলেপাথর ও শ্বেত মর্মর। বলা যায়, আকবরের আমলের বেলে পাথর এবং শাহজাহানের প্রিয় শ্বেত মর্মর উপকরণের যুগসন্ধিক্ষণ দিল জাহাঙ্গীরের আমল। তাঁর স্থাপত্যকলায় মুসলিম খিলান রীতি এবং হিন্দু স্তম্ভ-সদল রীতি (tribeate) অনুসৃত হয়েছিল। তবে অলংকরণের কাজে খোদাই নকশার অধিক প্রয়োগ দেখা যায়।
নূরজাহানের উদ্যোগে নির্মিত তাঁর পিতা ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধিসৌধ শিল্পকলার ইতিহাসে একটি কৃতিত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। আগ্রার সন্নিকটে যমুনার বামতীরে স্থাপিত এই সৌধের নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। এই স্মৃতিসৌধটি চিরাচরিত কর্ম কান্ড বেলেপাথরের পরিবর্তে আগাগোড়া মার্বেল পাথরে নির্মিত করে এক নবযুগের সূচনা করেছে। পরবর্তীকালে শাহজাহানের আমলে এই ধারার চরম বিকাশ ঘটে।
অভ্যন্তরীণ অলঙ্করণের কাজে রঙীন মোজাইক টালির ব্যবহার, যা পিয়েত্রা ডুরা (Pietra dura) রীতি নামে পরিচিত, একে অনন্যতা দিয়েছে।
শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল স্থাপত্যকর্মের 'স্বর্ণযুগ বলা হয়। আগ্রা দুর্গ, দিল্লী দুর্গ, লাহোর দুর্গ এবং সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থান তাঁর বহু স্থাপত্যকর্ম ছড়িয়ে আছে। এগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সৌধ "দেওয়ান-ই-আম', 'দেওয়ান-ই-খাস', 'মতি মসজিদ জামি মসজিদ', 'শিসমহল' এবং বিশ্ববন্দিত "তাজমহল"।
১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শাহজাহান দিল্লীতে 'শাহজাহানাবাদ' নামাঙ্কিত নতুন রাজধানী নগরী নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ফার্গুসনের মতে, এই নতুন নগরী কেবল প্রাচ্যে নয়, সম্ভবত সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সুরম্য অনংকৃত এবং স্থাপত্যকলার একটি সৃষ্টি। এখানেই রয়েছে সুপ্রসিদ্ধ "লালকেল্লা। এই প্রাসাদের বিশালতা ও উচ্চতা সারা বিশ্বের স্থাপত্যবিদদের বিস্ময় উদ্রেক করে।
মুঘল স্থাপত্যকর্মের গৌরবময় যুগের অবসান ঘটে ঔরসজেবের সিংহাসনারোহণের সঙ্গে সঙ্গে। কঠোরভাবে ধর্মবিশ্বাসী ঔরঙ্গজেবের বিচারে ব্যয়বহুল এবং অলংকৃত স্থাপত্যকর্ম ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক ভাবে অন্যায় ও অপ্রয়োজনীয়। শিল্প-স্থাপত্যের লালন-পালনের জন্য যে রসিক মনের প্রয়োজন, তা কঠোর বাস্তববাদী ঔরঙ্গজেবের স্বভাবতই ছিল না। তারা বলে বেশ কিছু নির্মাণ হলেও স্থাপত্য কর্মের গুণগত বিচারে সেগুলি উৎকর্ষের বিচারে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই পন্ডিতরা মনে করেন।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------