হিন্দু রাজসভায় গীতবাদ্য আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। মুসলমান শাসকরাও সেই ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হননি। সুলতানি যুগে আমীর খসরু সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে মধ্য-এশিয়ার সঙ্গীতধারার পরিবর্তন ঘটান এবং প্রাচীন হিন্দু সঙ্গীতকলার ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে তাকে একটি নতুন রূপ দেন। ঔরঙ্গজেব ব্যতীত মহান মুঘল শাসকদের প্রায় সকলেই ছিলেন সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক ও অনুরাগী। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানগণ মালবের রাজবাহাদুর প্রমুখ ও সমকালীন যুগে সঙ্গীতকলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র, Source- (check here |
বাবর ও হুমায়ুন সুকুমার কলার মত সঙ্গীত বিষয়েও সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন না। কথিত আছে, বাবর সঙ্গীত-ধারা সম্পর্কে একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। হুমায়ূন এবং তাঁর হারেমের রমণীগণ নিয়মিত সঙ্গীত-নৃত্য উপভোগ করতেন বলেই জানা যায়। আকবরের আমলে সঙ্গীতচর্চাও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। সম্রাট স্বয়ং এই কলার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন তিনি কেবল সঙ্গীতের শ্রোতা বা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, আবুল ফজল লিখছেন আকবর সঙ্গীতের সমালোচক ও স্রষ্টা ছিলেন।
আবুল ফজল আকবরের রাজসভায় উপস্থিত ৩৬ জন সঙ্গীতকারের নাম উল্লেখ করেছেন যাদের মধ্যে ছিলেন সেকালের দুই বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মিঞা তানসেন এবং মালবের বাজবাহাদুর। সঙ্গীত-প্রতিভার কারণেই আকবর বাজবাহাদুরকে হাজার-মনসবদারি প্রদান করে সম্মানিত করেছিলেন। নিঃসন্দেহে সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত-প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মিঞা তানসেন।
কথিত আছে, একবার তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে যমুনার জলপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তানসেনের মত প্রতিভাবান সঙ্গীতকার ভারতবর্ষে বিগত এক হাজার বছরে আবির্ভূত হননি বলে আবুল ফজল মনে করেন। তানসেনের প্রায় সমান প্রতিভার অধিকারী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সমকালীন সঙ্গীতকার ছিলেন বৈজু বাওরা।
জাহাঙ্গীরের আমলেও সঙ্গীত ও সঙ্গীতকারদের যথেষ্ট কদর ছিল। পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ এর রচনা থেকে সমকালীন সঙ্গীত চর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা যায়। শাহজাহান কেবল সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, নিজেও সঙ্গীত পরিবেশন করে আনন্দ উপভোগ করতেন। টেভার্নিয়ের বিবরণে তৎকালীন রাজদরবারে সঙ্গীতময় পরিবেশ রচনা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আচার্য যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে, “শাহজাহানের গানের গলা এত মিষ্টি ছিল যে, পার্থিব চিন্তামুক্ত হৃদয়ে তা শ্রবণ করলে অসীম শান্তি লাভ করা যেত।" তাঁর আমলের বিখ্যাত দু'জন সঙ্গীতসাধক ছিলেন রামদাস এবং মহাপাত্র।
অন্যান্য সুকুমার কলার মত সঙ্গীতের প্রতিও ঔরঙ্গজেব ছিলেন বিমুখ এবং বিরূপ। ধর্মান্ধ ও রসবিমুখ মনে তিনি সঙ্গীতকলাকেও দেশ থেকে চিরবিদায় দেবার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গীতচর্চা নিষিদ্ধ হয় সরকারি আদেশে। অবশ্য এতদসত্ত্বেও ঔরঙ্গজেবের আমলেই সঙ্গীতকলার চূড়ান্ত নির্বাসন ঘটেছিল, একথা মনে হবার কোন কারণ নেই। আমীর ওমরাহরা গোপনে যথারীতি সঙ্গীতচর্চা ও সঙ্গীতকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, আলোচ্যপর্বে সঙ্গীত ও নৃত্যকলার ওপর গবেষণা চলে এবং সঙ্গীতশাস্ত্র সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়।
............ সমাপ্তি...........
✍️লেখিকা পরিচিতি
📖তথ্যসূত্র
- Poonam Dalal Dahiya, "Ancient and Medieval India".
- Upinder Singh, "A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century".
📖সম্পর্কিত বিষয়
- আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার (আরো পড়ুন)।
- দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায় (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (আরো পড়ুন)।
- মুঘল আমলে সেচ ব্যবস্থা (আরো পড়ুন)।
সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগলো। আপনার যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানতে সাহায্য করুন।
------------🙏---------------